কোশ বিভাজন
কোশবিভাজনের সংজ্ঞা (Definition of Cell division)
যে পদ্ধতিতে একটি মাতৃকোশ থেকে দুটি বা তার বেশি অপত্য কোশ উৎপন্ন হয়, তাকে কোশবিভাজন বলে।
কোশবিভাজনের প্রথমে নিউক্লিয়াস ও পরে সাইটোপ্লাজম-এর বিভাজন শুরু হলেও প্রায় একসাথেই শেষ হয়।
কোশবিভাজনের কারণ (Causes of Cell Division)
- (1) কোশের সাইটোপ্লাজমের তুলনায় নিউক্লিয়াসের আয়তন বৃদ্ধি পেলে অর্থাৎ DNA-এর পরিমাণ দ্বিগুণ হলে কোশ বিভাজিত হয়।
- (2) কোশের বিপাকের হার বেশি হলে কোশ বিভাজিত হয়।
- (3) ক্ষতস্থান সৃষ্টি হলে কোশ বিভাজিত হয়।
- (4) RNA-এর তুলনায় DNA বেশি হলে কোশ বিভাজিত হয়।
- (5) হরমোনের প্রভাবে কোশ বিভাজিত হয়।
কোশবিভাজনের তাৎপর্য (Significance of Cell Division)
- (1) কোশ বিভাজিত হলে কোশের সংখ্যা বাড়ে এবং ভ্রূণের পরিস্ফুটন হয়। ফলে একটি কোশ থেকে বহুকোশী জীবদেহ গঠিত হয়।
- (2) কোশ বিভাজিত হয়ে ক্ষতস্থান পূরণ করে।
- (3) কোশবিভাজনের মাধ্যমে রেণু অথবা জননকোশ উৎপন্ন হয়।
- (4) এককোশী জীবে কোশবিভাজনের মাধ্যমে নতুন অপত্যজীবের সৃষ্টি হয়।
কোশবিভাজনের প্রকারভেদ (Types of Cell Division)
জীবদেহে তিন প্রকারের কোশবিভাজন পদ্ধতি বর্তমান। যথা—
- (1) অ্যামাইটোসিস,
- (2) মাইটোসিস এবং
- (3) মিয়োসিস।
1. অ্যামাইটোসিস (Amitosis) :
সংজ্ঞা (Definition) :
যেপ্রকার কোশবিভাজনে বেমতন্তু গঠন এবং নিউক্লীয় পর্দার অবলুপ্তি ছাড়াই নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম খাঁজ সৃষ্টির মাধ্যমে সরাসরি বিভক্ত হয়ে দুটি অপত্যকোশ সৃষ্টি করে, তাকে অ্যামাইটোসিস বা প্রত্যক্ষ কোশবিভাজন বলে।
সংঘটনস্থল (Place of Occurance) :
অ্যামিবা প্রভৃতি আদ্যপ্রাণী, ইস্ট প্রভৃতি ছত্রাক, কারা প্রভৃতি শৈবালে অ্যামাইটোসিস বিভাজন ঘটে।
তাৎপর্য (Significance) :
(i) বংশবিস্তার : কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই খুব দ্রুত কোশবিভাজন ঘটিয়ে এককোশী জীব (যেমন—অ্যামিবা, ইস্ট) এই প্রক্রিয়ায় বংশবিস্তার করে।
(ii) দেহবৃদ্ধি : কিছু বহুকোশী জীবে (যেমন—কারা, স্পাইরোগাইরা) এইপ্রকার বিভাজনের ফলে দ্রুত দেহবৃদ্ধি ঘটে।
2. মাইটোসিস (Mitosis) বা মাইটোটিক কোশবিভাজন (Mitotic Cell Division) :
বৈশিষ্ট্য (Characteristics) :
- (1) দেহকোশে এইপ্রকার বিভাজন ঘটে দেহবৃদ্ধি ঘটায়।
- (2) বেমতন্তু গঠিত হয় এবং নিউক্লীয় পর্দা বিলুপ্ত হয়।
- (3) ক্রোমোজোম লম্বালম্বি দু-ভাগ হয়।
- (4) মাতৃকোশটি বিভাজিত হয়ে সমসংখ্যক ও সমগুণসম্পন্ন ক্রোমোজোম- যুক্ত দুটি অপত্য কোশ উৎপন্ন করে।
সংজ্ঞা (Definition) :
যে কোশবিভাজন পদ্ধতিতে জীবের দেহকোশ বেমতন্তু গঠন, নিউক্লীয় পর্দার অবলুপ্তি, ক্রোমোজোমের লম্ববিভাজন প্রভৃতি বিশেষ ঘটনার মাধ্যমে বিভাজিত হয়ে সমগুণসম্পন্ন দুটি অপত্য কোশ উৎপন্ন হয়, তাকে মাইটোসিস বা মাইটোটিক বিভাজন বলে।
সংঘটনস্থল (Place of Occurance) :
- (1) বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহকোশে মাইটোসিস ঘটে।
- (2) উদ্ভিদের বর্ধনশীল অঙ্গের ভাজককলায় এবং প্রাণীর নির্দিষ্ট বয়ঃসীমা পর্যন্ত সমগ্র দেহকোশে মাইটোসিস ঘটে।
- (3) রেণু মাতৃকোশ এবং জনন মাতৃকোশ সৃষ্টিও মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় ঘটে ।
তাৎপর্য ( Significance ) :
1. কোশের আয়তন বজায় রাখা : মাইটোসিস কোশবিভাজনের মাধ্যমে কোশের DNA,RNA ও সাইটোপ্লাজমের নির্দিষ্ট অনুপাত এবং কোশের প্রকৃত আয়তন বজায় থাকে।
2 বহুকোশী জীবদেহে গঠন : একটিমাত্র কোশ মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বারবার বিভাজিত হয়ে বহুকোশ যুক্ত জীবদেহে গঠিত হয়।
3. পরিস্ফুরন : মাইটোসিস বিভাজনের ফলে জীবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সৃষ্টি (পরিস্ফুরন) হয় ।
4. বংশবৃদ্ধি : এককোশী জীবে মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় কোশ বিভাজিত হয়ে নতুন জীবের সৃষ্টি হয়। অঙ্গজজননেও মাইটোসিস প্রয়োজন।
5. ক্ষয়পূরণ : স্বাভাবিক ক্ষয় অথবা আঘাতজনিত ক্ষয় মাইটোসিস বিভাজনের ফলে পূর্ণ হয়ে যায়।
6. জিনের সমবণ্টন : ক্রোমোজোমের লম্ব বিভাজনের মাধ্যমে সমসংখ্যক ও সমগুণসম্পন্ন ক্রোমোজোমবিশিষ্ট, অপত্য কোশ সৃষ্টি হয়। ফলে জীবের সকল দেহকোশে জিনের সমবণ্টন ঘটে।
3. মিয়োসিস (Meiosis) বা মিয়োটিক কোশবিভাজন (Meiotic Cell Division)
বৈশিষ্ট্য (Characteristics) :
- (1) রেণু এবং জননকোশ উৎপন্ন করার জন্য মিয়োসিস ঘটে।
- (2) এই বিভাজনে মাতৃকোশটি পরপর দুবার বিভাজিত হয় (মাঝে কোনো ইন্টারফেজ দশা ছাড়াই) এবং চারটি অপত্য কোশ গঠন করে।
- (3) মিয়োসিসের প্রথম বিভাজনে কোশের সমসংস্থ ক্রোমোজোমগুলি উভয়ের মধ্যে খণ্ডাংশের বিনিময় ঘটিয়ে আলাদা আলাদা অপত্য কোশে যাওয়ায় অপত্য কোশের ক্রোমোজোম অর্ধেক হয়ে যায়।
- (4) মিয়োসিসের দ্বিতীয় বিভাজন মাইটোসিস বিভাজনের মতো। ফলে প্রথম বিভাজনে ডিপ্লয়েড (2n) কোশ হ্যাপ্লয়েড (n) কোশে পরিণত হয় এবং দ্বিতীয় বিভাজনের পর হ্যাপ্লয়েডই (n) থাকে।
সংজ্ঞা (Definition) :
যে কোশবিভাজন প্রক্রিয়ায় সমসংস্থ ক্রোমোজোমের দেহাংশের বিনিময় প্রভৃতি ঘটনার মাধ্যমে ডিপ্লয়েড (2n) কোশ পরপর দুবার বিভাজিত হয়ে অর্ধসংখ্যক ক্রোমোজোমযুক্ত চারটি হ্যাপ্লয়েড (n) কোশ উৎপন্ন করে, তাকে মিয়োসিস বা মিয়োটিক বিভাজন বলে।
সংঘটনস্থল (Place of Occurance) :
- (1) জনন মাতৃকোশ ও রেণু মাতৃকোশে মিয়োসিস হয়।
- (2) সপুষ্পক উদ্ভিদের পরাগধানী ও ডিম্বকের মধ্যে এবং উন্নত প্রাণীদেহে শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয়-এর মধ্যে মিয়োসিস ঘটে।
- (3) নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদের রেণুস্থলী এবং জননকোশাধারে মিয়োসিস হয়।
- (4) কিছু নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদের জাইগোটে মিয়োসিস হয় (যেমন—মিউকর)।
তাৎপর্য (Significance) :
1. প্রজাতির ক্রোমোজোম সংখ্যা ধ্রুবক রাখা : মিয়োসিস প্রক্রিয়ায় ডিপ্লয়েড (2n) কোশ থেকে অর্ধসংখ্যক ক্রোমোজোমযুক্ত হ্যাপ্লয়েড (n) কোশ উৎপন্ন হয়। যৌনজননে এরূপ দুটি হ্যাপ্লয়েড কোশ মিলিত হয়ে ডিপ্লয়েড কোশযুক্ত জীব গঠন করে। ক্রোমোজোম সংখ্যা অর্ধেক না হলে যৌন জননের ফলে প্রতিটি প্রজাতিতে ক্রোমোজোম সংখ্যা গুণিতক হারে বেড়ে যেত; যেটি সম্ভব নয়। তাই মিয়োসিস প্রক্রিয়া জননকোশ উৎপন্ন হওয়ার সময় ক্রোমোজোম সংখ্যার হ্রাস ঘটিয়ে প্রজাতির ক্রোমোজোম সংখ্যা ধ্রুবক রাখে।
2. জিনগত প্রকরণ ঘটানো : মিয়োসিস প্রক্রিয়ায় সমসংস্থ ক্রোমোজোম জোড়ার ননসিস্টার ক্রোমোটিডের মধ্যে দেহাংশের বিনিময় (ক্রসিং ওভার) হওয়ায় জিনের পুনঃসংযুক্তি (recombination) ঘটে। এর ফলে জীবের মধ্যে জিনগত প্রকরণের (genetic variation) উদ্ভব হয়, যা অভিব্যক্তিতে সহায়তা করে। 3. জনুক্রম ঘটানো : জীবদেহে হ্যাপ্লয়েড ও ডিপ্লয়েড দশার পর্যায় ক্রমিক আবর্তন অর্থাৎ জনুক্রম ঘটে। এই জনুক্রমে ডিপ্লয়েড (2n) দশা থেকে হ্যাপ্লয়েড (n) দশায় পরিণত হতে মিয়োসিস বিভাজন অপরিহার্য।
পরোক্ষ কোশবিভাজন কী?
যে প্রকার কোশবিভাজনে বেমতত্ত্ব গঠন প্রভৃতি বিশেষ্য ঘটনার মাধ্যমে নিউক্লিয়াস বিভাজিত হয় তাকে পরোক্ষ কোশবিভাজন বলে। যেমন—মাইটোসিস ও মিয়োসিস।
মাইটোসিসকে সমবিভাজন (Equational division) বলে কেন?
মাইটোসিস কোশবিভাজনে মাতৃকোশের ক্রমোজোমের সমসংখ্যক ও সমগুণসম্পন্ন ক্রোমোজোমযুক্ত দুটি অপত্য কোশ উৎপন্ন হয় বলে, মাইটোসিসকে সমবিভাজন বা সদৃশ বিভাজন বলে।
মিয়োসিসকে হ্রাসবিভাজন (Reduction division) বলে কেন?
মিয়োসিস কোশ- বিভাজনে উৎপন্ন অপত্য কোশে ক্রোমোজোম সংখ্যার হ্রাস ঘটে এবং এটি মাতৃকোশের ক্রোমোজোম সংখ্যার অর্ধেক হয়ে যায়, তাই মিয়োসিসকে হ্রাসবিভাজন বলে।