কর্ণ বা শ্রবণেন্দ্রিয়
কর্ণ বা শ্রবণেন্দ্রিয় (Ear or The organ of Hearing)
শ্রুতিমধুর বা বিরক্তিকর বিভিন্নরকম শব্দই আমরা কানের সাহায্যে শুনতে পাই।
সংজ্ঞা :
যে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে শব্দ অনুভূতি গৃহীত হয় ও শব্দ শোনা যায় তাকে কর্ণ বা শ্রবণেন্দ্রিয় বলে।
অবস্থান (Location) :
চক্ষুর পশ্চাতে মস্তকের উভয় দিকে দুটি কর্ণ অবস্থিত।
গঠন (Stucture) :
প্রতিটি কর্ণের তিনটি অংশ–বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ ও অন্তঃকর্ণ।
A. বহিঃকর্ণ (Externl ear) :
এর অংশগুলি হল কর্ণছত্র, কর্ণকুহর ও কর্ণপটহ ।
(a) কর্ণছত্র বা পিনা (Pinna) : এটি তরুণাস্থি ও অনৈচ্ছিক পেশি নির্মিত পাতলা ঝিনুকের খোলার মতো অংশ।
(b) কর্ণকুহর বা বহিঃকর্ণ নালি (External auditory meatus) : প্রায় এক ইঞ্জি লম্বা কর্ণছত্রের কেন্দ্রের ছিদ্র থেকে কর্ণপটহ পর্যন্ত বিস্তৃত নালিটি হল কর্ণকুহর।
(c) কর্ণপটহ (Tympanic membrane) : এটি কর্ণকুহরের শেষপ্রান্তে অবস্থিত পাতলা পর্দাবিশেষ যা মধ্যকর্ণের গহ্বর থেকে কর্ণকুহরকে পৃথক রাখে।
B. মধ্যকর্ণ বা টিমপ্যানিক গহ্বর (Middle ear or Tympanic cavity) :
মধ্যকর্ণটি একটি বায়ুপূর্ণ প্রকোষ্ঠ। এর মধ্যে তিনটি সঞ্চালনশীল ক্ষুদ্র কর্ণঅস্থি শৃঙ্খলাকারে যুক্ত থাকে। অস্থিগুলি যথাক্রমে ম্যালিয়াস* (Malleus) ইনকাস** (Incus) ও স্টেপিস*** (Stapes)। স্টেপিস যুক্ত থাকে ককলিয়ার ওভাল জানালার সাথে। মধ্যকর্ণস্থ বায়ুচাপের সমতা রাখার জন্য ইউস্টেচিয়ান নালি (eustachian tube) দ্বারা মধ্যকর্ণটি গলবিলের সাথে যুক্ত থাকে ।
C. অন্তঃকর্ণ বা ল্যাবাইরিথ (Internal ear or Labyrinth) :
পার্শ্বকরোটির কঠিন অংশে অনেকগুলো জটিল প্রকোষ্ঠ বা প্রণালী নিয়ে অন্তঃকর্ণ গঠিত। ওই অস্থিনির্মিত প্রকোষ্ঠকে অস্থিময় ল্যাবাইরিথ (bony labyrinth) এবং তার ভিতরে পর্দাযুক্ত প্রণালীকে পর্দাময় ল্যাবারিন্থ (membranous labyrinth) বলে।
অন্তঃকর্ণ তিনটি প্রকোষ্ঠ নিয়ে গঠিত, যথা—ককলিয়া, ভেস্টিবিউল ও অর্ধচক্রাকার নালি।
(a) ককলিয়া (Cochlea) : শামুকের খোলকের মতো পেঁচানো (21⁄2 প্যাচ) অস্থিময় প্রকোষ্ঠটি হল ককলিয়া। এটি রিসনারের পর্দা (Reissner's membrane) ও ব্যাসিলার পর্দা (Basilar membrane) দ্বারা তিনটি নলাকার উপপ্রকোষ্ঠে বিভক্ত। এগুলি হল :- (i) স্ক্যালা ভেস্টিবিউলি (Scala vestibuli)—রিসনারের পর্দার পাশে অবস্থিত, (ii) স্ক্যালা মিডিয়া (Scala media)—উভয় পর্দার মাঝে অবস্থিত। ও (iii) স্ক্যালা টিমপ্যানি (Scala tympany)—ব্যাসিলার পর্দার পাশে অবস্থিত। এন্ডোলিম্ফ (Endolymph) তরলপূর্ণ স্ক্যালামিডিয়া হেনসেনের নালি (duct of Hensen) দ্বারা ভেস্টিবিউল-এর সাথে যুক্ত। পেরিলিম্ফ (Perilymph) তরলে পূর্ণ স্ক্যালা ভেস্টিবিউল ও স্ক্যালা টিমপ্যানির অগ্রভাগ হেলিকোট্টিমা (Helicotrima) ছিদ্র দ্বারা যুক্ত থাকে। ব্যাসিলার পর্দার 24000 তন্তুর উপরে সারিবদ্ধভাবে প্রায় 24000 রোমশ কোশ (Haircell) দিয়ে গঠিত কর্টিযন্ত্র (Organ of Corti) অডিটরি স্নায়ুর সাথে যুক্ত এবং শব্দগ্রাহক রূপে কাজ করে।
(b) ভেস্টিবিউল (Vestibule) : ককলিয়ার সাথে যুক্ত এই অংশটি স্যাকিউল (Saciule) ও ইউট্রিকস্ (Utricle) নামক দুটি থলি নিয়ে গঠিত। ওই থলিদুটির এন্ডোলিম্ফে অটোলিথ (Otoliths) নামক CaCO2 যুক্ত দানা থাকে। ভেস্টিবিউলকে অটোলিথ যন্ত্রও বলে।
(c) অর্ধচক্রাকার নালি (Semicircular canals) : ভেস্টিবিউলের সাথে যুক্ত অর্থচক্রাকার তিনটি নালি পরস্পর সমকোণে থাকে। এদের মধ্যেও এন্ডোলিম্ফ থাকে।
কানের কাজ (Function of Ear) :
জ্ঞানেন্দ্রিয়রূপে কানের প্রধান কাজ হল শ্রবণ এবং অন্য কাজটি হল ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ।
1. শ্রবণ (Hearing) :
কোনো শব্দতরঙ্গ বাহিরের থেকে কর্ণছত্রে প্রতিফলিত হয়ে কর্ণকুহরের মধ্য দিয়ে কর্ণপটহে আঘাত করে। সেখান থেকে ম্যালিয়াস, ইনকাস ও স্টেপিসের মাধ্যমে ওভাল জানালা দিয়ে স্ক্যালা ভেস্টিবিউলির পেরিলিম্ফে যায়। এরপর হেলিকোট্টিমা ছিদ্র দিয়ে স্কালা টিমপ্যানির পেরিলিম্ফে এবং সেখান থেকে ব্যাসিলার পর্দার শ্রুতিগ্রাহক যন্ত্রের রোমশ কোশ দ্বারা গৃহীত হয়ে অডিটরি স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের শ্রবণকেন্দ্রে পৌঁছোলে শব্দের শনাক্তকরণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা শুনতে পাই এবং সতর্ক হই।
এন্ডোলিম্ফে পটাশিয়াম বেশি থাকে এবং পেরিলিম্ফে সোডিয়াম বেশি থাকে।
বায়ুতে শব্দতরঙ্গ → কর্ণছত্র → কর্ণকুহর → কর্ণপটহ → ম্যালিয়াস ⇒ ইনকাস স্টেপিস → ওভাল জানালা → স্ক্যালা ভেস্টিবিউলি → স্ক্যালা টিমপ্যানি → ব্যাসিলার পর্দা → কটিযন্ত্র → অডিটরি স্নায়ু → মস্তিষ্কের শ্রবণ কেন্দ্র।
2. ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ (Equilibrium) :
অর্ধচক্রাকার নালি ও অটোলিথ যন্ত্রে কিছু গ্রাহককোশ থাকে। দেহের স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে ওইসকল কোশ এন্ডোলিম্ফ ও অটোলিথ দ্বারা উদ্দীপিত হয় এবং সেই উদ্দীপনা স্নায়ুপথে মস্তিষ্কের ভারসাম্য কেন্দ্রে পৌঁছোলে পেশির সক্রিয়তায় দেহের ভারসাম্য রক্ষিত হয়।
কর্ণের কয়েকটি অংশের কাজঃ
নং | কর্ণের অংশ | কাজ |
---|---|---|
১ | বহিঃকর্ণ | কর্ণছত্র শব্দতরঙ্গের প্রতিফলন ঘটায় ও কর্ণকুহরে প্রেরণ করে। কর্ণকুহর শব্দতরঙ্গকে কর্ণপটহে প্রেরণ করে। কর্ণপটহ শব্দতরঙ্গকে মধ্যকর্ণে প্রেরণ করে। |
২ | মধ্যকর্ণ | ম্যালিয়াস, ইনকাস ও স্টেপিস ক্রমানুসারে কর্ণপটহ থেকে শব্দতরঙ্গকে ওভাল জানালা দিয়ে অন্তঃকর্ণে প্রেরণ করে। |
৩ | অন্তঃকর্ণ | ককলিয়া মধ্যকর্ণ থেকে শব্দ-অনুভূতি গ্রহণ করে মস্তিষ্কে পাঠায়। অর্ধচক্রাকার নালি ও অটোলিথ যন্ত্র ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে। অর্গ্যান অব কর্টি শব্দগ্রাহক যন্ত্র হিসাবে কাজ করে। |