উদ্ভিদের পরিবহন কৌশল
উদ্ভিদের পরিবহন কৌশল (Mechanism of Transportation on Plants)
উদ্ভিদের পরিবহন কৌশলকে প্রধান দুটি ভাগে ব্যাখ্যা করা যায়, যথা-A. জল ও লবণের পরিবহন এবং B. খাদ্যের পরিবহন।
A. জল ও লবণের পরিবহন (Translocation of water and salts):
এটি ঊর্ধ্বমুখী পরিবহন এবং এর দুটি পর্যায়, যথা-
- 1. মূলরোম দ্বারা জল ও লবণ শোষণ এবং জাইলেমে পাঠানো,
- 2. জাইলেমের ভিতর দিয়ে রসের উৎস্রোত।
1.জল ও লবণ শোষণ এবং জাইলেমে পাঠানো (Absorption of water and salts and its translocation to xylem):
যে পদ্ধতিতে উদ্ভিদ জল ও জলে দ্রবীভূত লবণ পরিবেশ থেকে দেহের মধ্যে গ্রহণ করে তাকে শোষণ বলে।
(a) জল শোষণ সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় পদ্ধতিতে ঘটে-
- (i) সক্রিয় জলশোষণ ইমবাইবিশন, ব্যাপন, অভিস্রবণ প্রভৃতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে এবং
- (ii) নিষ্ক্রিয় জলশোষণ প্রধানত বাষ্পমোচন টানের ফলে ঘটে।
(b) লবণশোষণও সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় পদ্ধতিতে ঘটে-
- (i) শক্তিব্যয় করে বিভিন্ন বাহকের দ্বারা ঘনত্বের বিপক্ষে যে শোষণ হয় তাকে সক্রিয় লবণশোষণ বলে।
- (ii) শক্তিব্যয় না করে এবং বাহক ছাড়াই কেবল ঘনত্বের স্বপক্ষে যে শোষণ হয় তাকে নিষ্ক্রিয় লবণশোষণ বলে।
2. রসের উৎস্রোত (Ascent of sap):
যে পদ্ধতিতে মূল দ্বারা শোষিত জল ও জলে দ্রবীভূত লবণ অর্থাৎ রস (sap) জাইলেম কলার মধ্য দিয়ে অভিকর্ষের বিপরীতে মূল থেকে উদ্ভিদের উপরের অঙ্গে (প্রধানত পাতায়) পৌঁছোয়, তাকে রসের উৎস্রোত বলে।
কীভাবে মৃত জাইলেম কলার মধ্য দিয়ে রসের উৎস্রোত ঘতে সে সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ্গুলির মধ্যে মূলজ চাপ এবং বাষ্পমোচন টান ও জলের সমসংযোগ মতবাদ আধুনিককালে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতবাদ। বিভিন্ন মতবাদগুলি সংক্ষেপে নিম্নে আলোচনা করা হলঃ
(a) কৈশিক বল (Capillary force) মতবাদঃ বোহম (Boehm, 1809)-এর মতে জাইলেমবাহিকার কৈশিক বল রসের উৎস্রোত ঘটায়।
(b) বায়ুমণ্ডলীয় চাপ (Atmospheric Pressure) মতবাদঃ অনেকের মতে বায়ুমণ্ডলের চাপের ফলেই রসের উৎস্রোত ঘটে।
(c) রিলে পাম্প (Relay Pump) মতবাদঃ গড্লিউস্কির (Godlewski, 1884) মতে জাইলেম প্যারেনকাইমা ও মজ্জাংশুর কোশের পাম্পিং পদ্ধতির দ্বারা রসের উৎস্রোত ঘটে।
(d) পালসেটরি মুভমেন্ট (Pulsatory movement) মতবাদঃ স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর (Sir J. C. Bose, 1923) মতে কর্টেক্সের ভিতরের স্তরের কোশগুলির ছান্দিক স্পন্দনের দ্বারা রসের উৎস্রোত ঘটে।
(e) ইমবাইবিশন চাপ (Imbibition force) মতবাদঃ স্যাক্স (Sachs, 1878)-এর মতে জাইলেমবাহিকার প্রাচীরের ইমবাইবিশন চাপই রসের উৎস্রোত ঘটায়।
(f) মূলজ চাপ মতবাদ (Root pressure theory): মূলরোম দ্বারা শোষিত জল কোশান্তর অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় মূলের কর্টেক্স অঞ্চলে পৌঁছে যে সম্মিলিত রসস্ফীতি চাপ সৃষ্টি করে তাকে মূলজ চাপ বলে। এই মূলজ চাপের দ্বারাই জল ও জলে দ্রবীভূত লবণ অন্তস্ত্বক ভেদ করে জাইলেমবাহিকার মধ্য দিয়ে উপরে ওঠে। এই মতবাদটি প্রথম স্টেফান হেল্স্ (Stephan Hales, 1769) ব্যাখ্যা করেন। পরে বহু বিজ্ঞানী, যেমন কান্ড্ এবং রোবনিক (Kundt & Robnik, 1998), এই মতবাদটি সমর্থন করে বলেছেন, মূলের কর্টেক্সের সবচেয়ে ভিতরের স্তরের যান্ত্রিক পাম্প পদ্ধতি (সাইকেলের পাম্পের মতো) অন্তস্ত্বকের কোশের প্লাজমোডেসমাটার মধ্য দিয়ে রসকে ঠেলে জাইলেমে পাঠানোর ফলে রসের উৎস্রোত ঘটে।
(g) সমসংযোগ-অসমসংযোগ বল এবং বাষ্পমোচন টান মতবাদ (Cohesion-adhesion force and Transpiration pull theory): এই মতবাদটি ডিক্সন ও জলি (Dixon & Joly, 1894) প্রথম ব্যাখ্যা করেন। পরে বহু বিজ্ঞানী যেমন লেভিট (Levitt, 1969) এটি সমর্থন করেন। এই মতবাদটি নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য অনুসারে ব্যাখ্যা করা যায়-
- (i) জাইলেমবাহিকার প্রান্তপ্রাচীর না থাকায় একটানা নলের মতো হয় এবং এতে অবিচ্ছিন্ন জলস্তম্ভ থাকতে পারে।
- (ii) জাইলেমবাহিকার প্রাচীরের সাথে জলের অসমসংযোগ (adhesion) বলের আকর্ষণে এবং জলের অণুগুলির মধ্যে সমসংযোগ (Cohesion) বলের আকর্ষণে জলস্তম্ভ দাঁড়িয়ে থাকে।
- (iii) বাষ্পমোচনের ফলে পত্ররন্ধ্র দিয়ে বাষ্পাকারে জল বেরিয়ে গেলে মেসোফিল কলায় জলের ঘাটতি হয়। ফলে পাতার জাইলেম থেকে মেসোফিল কলাতে জল যুক্ত হয় এবং তখনই জাইলেমবাহিকার জলস্তম্ভে যে একটি ঊর্ধ্বমুখী টানের সৃষ্টি হয়, তাকে বাষ্পমোচন টান (Transpiration pull) বলে। এই টানের ফলে জলের তীব্র সমসংযোগ বলের জন্য একটানা জলস্তম্ভ উপরে উঠতে থাকে এবং সাথে সাথেই মূলজ চাপের দ্বারা জাইলেমে জলসংযোজন ঘটে। এইভাবে মূলজ চাপ এসের উৎস্রোত শুরু করায় (‘Starter’) এবং বাষ্পমোচন টান চালকযন্ত্ররূপে (‘Motor’) পদ্ধতিটি ঘটতে থাকে।
B. খাদ্যের পরিবহন (Transportation of food):
উদ্ভিদের পাতায় দিনের বেলা সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজ উৎপন্ন হয় এবং অ্যামাইনো অ্যাসিড ইত্যাদি অন্যান্য জৈব যৌগ দিবারাত্র বিভিন্ন বিপাক ক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়। এই জৈব উপাদাঙ্গুলি পাতা থেকে ফ্লোয়েম কলার মাধ্যমে উদ্ভিদের সমগ্র অংশে ছড়িয়ে পড়ে। কখনো-কখনো সঞ্চয় স্থান থেকে খাদ্যাপাদান ফ্লোয়েম কলার মাধ্যমে বর্ধনশীল অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ফ্লোয়েমের সিভনলের প্রান্তপ্রাচীর ছিদ্রযুক্ত (সিভপ্লেট) হওয়ার জলে দ্রবীভূত খাদ্য সহজে এক সিভনল থেকে অপর সিভনলে বেশি ঘনত্বের থেকে কম ঘনত্বের দিকে যেতে পারে।
এই খাদ্যপরিবহন প্রধানত নিম্নমুখী হলেও এটি উভয়মুখেই ঘটতে পারে। খাদ্যপরিবহনের কয়েকটি মতবাদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল-
(a) সাইটোপ্লাজমীয় আবর্তন (Cytoplasmic streaming) মতবাদঃ ডি ভ্রিস (De Vries, 1885) ইসরিখ (Eschrich, 1967) প্রভৃতি বিজ্ঞানীদের মতে সিভনলের সাইটোপ্লাজম সর্বদা একটি নির্দিষ্ট দিকে আবর্তিত হওয়ায় খাদ্যকণা একদিক থেকে অপরদিকে পৌঁছোতে পারে।
(b) তড়িৎ অভিস্রবণ (Electro-Osmotic) মতবাদঃ বিজ্ঞানী স্প্যানার (Spanner 1958)-এর মতে সিভপ্লেটের দু-দিকে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়নের অসমতার ফলে পটাশিয়াম (K+) আয়নের সাথে জলে দ্রবীভূত খাদ্য ধনাত্মক দিক থেকে ঋণাত্মক দিকে পৌঁছে যায়।
(c) সংকোচনশীল প্রোটিন (Contractile protein) মতবাদঃ বিজ্ঞানী ফেনসাম (Fensom, 1974)-এর মতে, সিভনলের মধ্যে অবস্থিত সূক্ষ্ম প্রোটিনতন্তুর জালিকা পরস্পর সিভছিদ্রের মাধ্যমে যুক্ত থাকে এবং এই সংকোচনশীল প্রোটিন তন্তুর স্পন্দনের (ব্রাউনিয়ান চলনের মতো) মাধ্যমে খাদ্যবস্তুর দ্বিমুখী পরিবহন ঘটে।