অঙ্গসংস্থানিক ও শারীরস্থানিক প্রমাণ
অঙ্গসংস্থানিক ও শারীরস্থানিক প্রমাণ (Morphological and Anatomi- cal Evidence)
বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন অর্থাৎ অঙ্গসংস্থান (Morphology) এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন ও শরীরগত অবস্থান অর্থাৎ শারীরস্থান (Anatorny) পর্যবেক্ষণ করে অভিব্যক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন—
A. তুলনামূলক শারীরস্থানঘটিত প্রমাণ (Evidences from comparative anatorny) :
বিভিন্ন জীবের তুলনামূলক শারীরস্থান পর্যালোচনা করলে কোন্ জীব থেকে কোন্ জীবের উদ্ভব ঘটেছে তা জানা যায়।
হূৎপিণ্ডের পর্যবেক্ষণ :
যেমন বিভিন্ন শ্রেণির মেরুদণ্ডী প্রাণীদের হৃৎপিণ্ডের গঠন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়—
- (1) মৎসের হৃৎপিণ্ডের একটি অলিন্দ ও একটি নিলয় এবং এদের হৃৎপিণ্ডে একটি চক্রের মাধ্যমে সর্বদা দূষিত রক্তপ্রবাহিত হয়।
- (2) উভচরের হৃৎপিণ্ডের দুটি অলিন্দ ও একটি নিলয় এবং দুটি চক্রের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত হলেও নিলয়ে দূষিত ও বিশুদ্ধ রক্তের মিশ্রণ ঘটে।
- (3) সরীসৃপের হৃৎপিণ্ডের গঠন প্রায় উভচরের মতো হলেও নিলয়টি অসম্পূর্ণভাবে বিভক্ত।
- (4) পক্ষী ও স্তন্যপায়ীর হৃৎপিণ্ডের দুটি অলিন্দ ও দুটি নিলয় এবং দূষিত ও বিশুদ্ধ রক্ত সম্পূর্ণ আলাদাভাবে প্রবাহিত হয়।
মন্তব্য :
উল্লিখিত পর্যবেক্ষণ থেকে অভিব্যক্তির প্রমাণ সম্পর্কে নিম্নলিখিত মন্তব্যগুলি করা যায়—
- (1) ‘সকল মেরুদণ্ডীর হৃৎপিণ্ডে অলিন্দ ও নিলয় উপস্থিত এবং এগুলি সংবহনের কাজে যুক্ত'—এই মৌলিকত্ব থেকে প্রমাণিত হয় সকল মেরুদণ্ডীই একই পূর্বপুরুষ থেকে সৃষ্ট।
- (2) কিন্তু ক্রমপর্যায়ে মৎস্য থেকে উভচর ও সরীসৃপ হয়ে পক্ষী ও স্তন্যপায়ীর হূৎপিণ্ডের গাঠনিক জটিলতা দেখে বলা যায় মেরুদণ্ডীর গঠন ক্রমাগত সরল থেকে জটিলতর হয়েছে।
- (3) বিপাকহার ক্রমপর্যায়ে মৎস্য থেকে স্তন্যপায়ীতে বেশি হওয়ায় এরূপ গাঠনিক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে এবং ‘মৎস্য → উভচর → সরীসৃপ → পক্ষী ও স্তন্যপায়ী’–এই পর্যায়ক্রমে অভিব্যক্তির মাধ্যমে একশ্রেণির মেরুদণ্ডীর থেকে অপর শ্রেণির মেরুদণ্ডীর উদ্ভব ঘটেছে।
একইরকমভাবে বিভিন্ন শ্রেণির মেরুদণ্ডীর মস্তিষ্কের গঠন বা কশেরুকার গঠন অথবা উদ্ভিদের ফুলের গঠন পর্যালোচনা করেও একইরকম প্রমাণ পাওয়া যায়।
B. সমসংস্থ ও সমবৃত্তীয় অঙ্গঘটিত প্রমাণ (Evidences form Homolo- gous and Analogous Organs) :
1. সমসংস্থ অঙ্গ (Homologous Organs) :
জীবদেহের যেসব অঙ্গের উৎপত্তি ও মূল গঠন একই কিন্তু কাজ ভিন্ন ধরনের হয় তাদের সমসংস্থ অঙ্গ বলে। বিভিন্ন শ্রেণির মেরুদণ্ডী প্রাণীদের অগ্রপদ পরস্পর সমসংস্থ অঙ্গ। যেমন ব্যাং-এর অগ্রপদ, পাখির ডানা, বাদুরের ডানা, তিমির, প্যাডেল, ঘোড়ার অগ্রপদ ও মানুষের হাত—এদের উৎপত্তি এবং অস্থির গঠন একইরকম। সবই হিউমেরাস, রেডিয়াস, আলনা, কারপাল, মেটাকারপাল প্রভৃতি নিয়ে গঠিত। কিন্তু সমসংস্থ অঙ্গগুলির কাজ ভিন্ন। যেমন ব্যাং-এর অগ্রপদ গমনে, পাখির ও বাদুড়ের ডানা উড়তে, তিমির প্যাডেল সাঁতার দিতে, ঘোড়ার অগ্রপদ দৌড়োতে, মানুষের হাত বিভিন্ন কাজ করতে সহায়তা করে।
মন্তব্য : বহিরাকৃতি ও কাজের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও উল্লিখিত অঙ্গগুলির উৎপত্তি ও মূলগঠন একইরকম হওয়ায় উক্ত প্রাণীগুলি একই উদ্ংশীয় জীব থেকে উদ্ভুত।
> উদ্ভিদের সমসংস্থ অঙ্গের উদাহরণ কলশপত্রীর পাতা, মটরের পত্র আকর্ষ, ফণিমনসার পত্রকণ্টক, জবা পাতা প্রভৃতি।
2. সমবৃত্তীয় অঙ্গ (Analogous Organs) :
জীবদেহের যেসব অঙ্গের কাজ একই প্রকার কিন্তু উৎপত্তি ও গঠন ভিন্ন ধরনের হয় তাদের সমবৃত্তীয় অঙ্গ বলে । যেমন - পতঙ্গেরডানা ও পাখির ডানা পরস্পর সমবৃত্তীয় অঙ্গ।
মন্তব্য : সমবৃত্তীয় অঙ্গগুলির কাজ একই হলেও উৎপত্তি ও গঠন ভিন্ন হওয়ায় পতঙ্গ ও পাখির উৎপত্তি ভিন্ন জীব থেকে হয়েছে। কিন্তু একই পরিবেশে থাকার জন্য এদের সমান্তরাল অভিব্যক্তি ঘটেছে।
> উদ্ভিদের সমবৃত্তীয় অঙ্গের উদাহরণ হল মটরের পত্র আকর্ষ ও ঝুমকোলতার শাখা আকর্ষ।
C. লুপ্তপ্রায় বা নিষ্ক্রিয় অঙ্গঘটিত প্রমাণ (Evidences from Vestigeal Organs) :
জীবদেহের পূর্বপুরুষের দেহে সক্রিয় ছিল এরুপ যে অঙ্গগুলি কাজ না থাকার ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত অবস্থায় পরিণত হয় তাকে লুপ্তপ্রায় বা নিষ্ক্রিয় অঙ্গ বলে।
যেমন—মানুষের ভার্মিফর্ম অ্যাপেনডিক্স, কক্সিস, নিকটিটেটিং মেমব্রেন প্রভৃতি নিষ্ক্রিয় অঙ্গ। গিনিপিগ জাতীয় তৃণভোজীদের সক্রিয় সিকাম থাকে যা মানুষের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় অ্যাপেনডিক্স-এ পরিণত হয়েছে। আবার বানরের সক্রিয় লেজ মানুষের ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের প্রান্তে কক্সিসে পরিণত হয়েছে।
মন্তব্য : নিষ্ক্রিয় অঙ্গযুক্ত জীবগুলি ওই প্রকারের সক্রিয় অঙ্গযুক্ত জীব থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে।
> উদ্ভিদের নিষ্ক্রিয় অঙ্গের উদাহরণ হল ভূমিম্নস্থ কাণ্ডের শল্কপত্র, কলাবতীর বধ্যাপুংকেশর বা স্ট্যামিনোড, শতমূলির বন্ধ্যা গর্ভকেশর বা পিস্টিলোড প্রভৃতি।
D. সংযোগরক্ষাকারী প্রাণী ও উদ্ভিদ (Linked animals and plants) :
যেসকল প্রাণী বা উদ্ভিদ দুটি পর্ব বা শ্রেণির বৈশিষ্ট্য বহন করে তাদের সংযোগরক্ষাকারী প্রাণী বা উদ্ভিদ বলে।
স্সংযোগরক্ষাকারী প্রাণীর উদাহরণ হল :
পেরিপেটাস (Peripetus) – যার অঙ্গুরিমাল ও সন্ধিপদের বৈশিষ্ট্য আছে (রেচন অঙ্গ নেফ্রিডিয়া কিন্তু শ্বাস অঙ্গ শ্বাসনালি);
হংসচঞ (Platipus) — যার সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ীর বৈশিষ্ট্য আছে (ডিম পাড়ে কিন্তু দেহে লোম আছে ও দুগ্ধ ক্ষরিত হয়)।
সংযোগরক্ষাকারী উদ্ভিদের উদাহরণ হল :
নিটাম (Gnetum)- যার ব্যক্তবীজী ও গুপ্তবীজীর বৈশিষ্ট্য বর্তমান;
ট্রিফার্ন (Tree Fern)— যার ফার্ন ও ব্যক্তবীজীর বৈশিষ্ট্য বর্তমান।
মন্তব্য : সংযোগরক্ষাকারী জীবগুলি থেকে জানা যায় কোন্ পর্ব বা শ্রেণির থেকে কোন্ পর্ব বা শ্রেণির জীবের উদ্ভব ঘটেছে।
হৃতযোজক বা মিসিং লিঙ্ক (Missing Link) :
দুটি জীবগোষ্ঠীর মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্য যুক্ত যেসকল জীব অধুনালুপ্ত এবং যাদের সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবে অভিব্যক্তির প্রমাণে ফাঁক থেকে যায় তাদের মিসিং লিঙ্ক বলে।
যেমন—আর্কিয়োপটেরিক্স (Archeopteryx) নামে একটি জীবাশ্মের সন্ধান পাওয়া গেছে যার মধ্যে সরীসৃপ ও পক্ষীশ্রেণির বৈশিষ্ট্য বর্তমান।
সরীসৃপের বৈশিষ্ট্য :
- (1) চোয়ালে এনামেলযুক্ত দাঁত আছে।
- (2) স্টার্নামে কিল অনুপস্থিত।
পক্ষীর বৈশিষ্ট্য :
- (1) অগ্রপদ ডানায় রূপান্তরিত ও দেহ পালকে আবৃত।
- (2) চঞ্জু উপস্থিত।
এই আর্কিয়োপটেরিক্স-এর বৈশিষ্ট্যদেখে বলা যায় সরীসৃপ থেকে পক্ষীশ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে।
সমসংস্থ ও সমবৃত্তীয় অঙ্গের পার্থক্য
নং | সমসংস্থ অঙ্গ | মেরুদণ্ডী প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্র |
---|---|---|
১ | উৎপত্তি ও গঠন একই কিন্তু কাজ ভিন্ন। | উৎপত্তি ও গঠন ভিন্ন কিন্তু কাজ একই। |
২ | অপসারী অভিযোজনের ফলে উৎপন্ন হয়। | অভিসারী অভিযোজনের ফলে উৎপন্ন হয়। |