ল্যামার্কবাদ
ল্যামার্কবাদ (Lamarckism) :
ল্যামার্কের পুরো নাম জ্যাঁ-ব্যাপ্তিস্তে পিয়েরি অ্যান্টনি দ্য ময়ে ল্যামার্ক (Jean-Baptiste Piere Antoine de Monet Lamark, 1744-1829)। তিনি প্রথম অভিব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ মতবাদ প্রণয়ন করেন। তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসাবিদ, উদ্ভিদবিদ ও প্রাণীবিদ (অমেরুদণ্ডী)। তিনি ‘Biology' শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। 1809 খ্রিস্টাব্দে তাঁর লেখা 'ফিলোসোফি জুয়োলজিক (‘Philosophie Zoologique') নামক গ্রন্থে জীবের বিবর্তন সম্পর্কে তত্ত্ব প্রকাশ করেন। বিবর্তন সম্পর্কে ল্যামার্কের এই তত্ত্বকে ল্যামার্কবাদ (Lamarkism) বলে।
ল্যামার্কবাদের সূত্রগুলির মধ্যে ‘অর্জিত গুণাবলির বংশানুসরণ' সূত্রটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ল্যামার্কের সূত্রগুলি নিম্নে আলোচিত হল—
1. সজ্ঞান প্রচেষ্টা (Conscious Efforts) :
ল্যামার্কের মতে পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে চলার উদ্দেশ্যে জীবের নিজের ভিতরকার চাহিদায় অর্থাৎ সজ্ঞান প্রচেষ্টায় নতুন নতুন অঙ্গের সৃষ্টি হয়।
2. ব্যবহার ও অব্যবহার (Use and disuse) :
ল্যামার্কের মতে জীব তার নিজের প্রয়োজনে কোনো অঙ্গকে ধারবাহিকভাবে অত্যধিক ব্যবহার করলে ওই অঙ্গগুলির বৃদ্ধি ভালো হয় এবং অঙ্গগুলি শক্তিশালী, সবল ও সুগঠিত হয়। অন্যদিকে কোনো অঙ্গের প্রয়োজন না থাকলে ওই অঙ্গের ব্যবহার না করায় ক্রমশ দুর্বল হয়ে নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়।
উদাহরণ—
ব্যবহারের উদাহরণ : জলজ পক্ষী (হাঁস প্রভৃতি) জলে সাঁতার কাটবার জন্য আঙুল প্রসারিত করায় আঙুলের গোড়ার পেশি ও চামড়ায় টান পড়ে লিপ্তপদ-এর সৃষ্টি হয়েছে।
অব্যবহারের উদাহরণ : সাপ গর্তের মধ্যে স্বল্পপরিসরে চলাফেরা করার জন্য পা-এর ব্যবহার না হয়ে ক্রমশ ছোটো হয়ে বিলুপ্ত হয়। এইভাবে পা-যুক্ত সাপ থেকে পা-হীন সাপের উদ্ভব ঘটেছে।
3. অর্জিত গুণাবলির (বৈশিষ্ট্যের) বংশানুসরণ (Inheritance of Acquired | characters) :
- (1) ল্যামার্কের মতে জীব তার জীবদ্দশায় পরিবেশের প্রভাবে নিজ প্রচেষ্টায় বিভিন্ন অঙ্গের ব্যবহার বা অব্যবহার করে যেসকল নতুন গুণ বা বৈশিষ্ট্যগুলি অর্জন করে সেগুলি বংশগতির অবিচ্ছিন্ন ধারায় অপত্যের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।
- (2) আবার এই অপত্য তার জীবদ্দশায় পরিবেশের প্রভাবে কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, সেগুলি সম্মিলিতভাবে তাদের অপত্যের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।
- (3) এইভাবে অর্জিত গুণাবলি পূর্বপুরুষ থেকে উত্তরপুরুষের দেহে ক্রমাগত পুঞ্জীভূত হয় এবং নতুন প্রজাতি সৃষ্টিতে সহায়তা করে। একেই অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ বলে।
> উদাহরণ—ল্যামার্কের মতে তৃণজাতীয় খাদ্যের অভাব ঘটায় ক্রমাগত উঁচু গাছ থেকে খাদ্যগ্রহণে অভ্যস্থ হওয়ায় জিরাফের গলা ও সামনের পা লম্বা হতে থাকে এবং ওই বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ ঘটতে থাকে। এইভাবে বেশ কয়েক বংশ পর বর্তমানের লম্বা গলাযুক্ত জিরাফের উদ্ভব ঘটে।
4. নতুন প্রজাতির উদ্ভব (Origin of new species) :
অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলি বংশপরম্পরায় পুঞ্জীভূত হতে থাকলে একসময় নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। অর্থাৎ জীবের অভিব্যক্তি ঘটে।
ল্যামার্কের মতবাদের বিরুদ্ধে যুক্তি :
- (1) ভাইসম্যান (Weisman) 22 প্রজন্ম ধরে ইঁদুরের লেজ কেটে দিয়ে লেজবিহীন ইঁদুর সৃষ্টি করতে পারেননি।
- (2) পেইন (Payne) ৬০ প্রজন্ম ধরে ড্রসোফিলা নামক মাছিকে অন্ধকার ঘরে রেখে দৃষ্টিহীন ড্রসোফিলা মাছির সৃষ্টি করতে পারেননি ।
নয়া ল্যামার্কবাদ (Neo Lamarckism) :
কোপ (Cope), প্যাকার্ড (Pakard), স্পেনসার (Spencer) প্রভৃতি বিজ্ঞানী লামার্কের মতবাদকে সংশোধিত রূপে প্রকাশ করেন, যাকে নয়া ল্যামার্কবাদ বলে।
এই মতবাদ হল—পরিবর্তনশীল পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার জন্য জীবের নতুন নতুন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সৃষ্টি হয় যার ফলে জীবে প্রকরণ দেখা যায়; যেটি বংশগতিতে বাহিত হওয়ায় প্রজাতির উদ্ভব ঘটে।