ডারউইন
ডারউইনবাদ (Darwinism) :
চার্লস রবার্ট ডারউইন (Charles Robert Darwin, 1809–1882) একজন ইংরেজ বিজ্ঞানী ছিলেন। 1831 খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘এইচ. এম. এস. বিগল' (H. M. S Beagle) নামে একটি জাহাজে পাঁচ বছর যাবৎ দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলবর্তী অঞ্চল এবং প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জের (বিশেষ করে গ্যালাপেগাস দ্বীপপুঞ্জ) বিভিন্ন রকম উদ্ভিদ ও প্রাণীর গঠনবৈশিষ্ট্য (যেমন ফিঞ্চ পাখি) পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং বিভিন্ন জীবের নমুনা সংগ্রহ করেন। ভ্রমণ থেকে প্রত্যাবর্তনের দীর্ঘ কয়েক বছর পর ভ্রমণকালীন অভিজ্ঞতা এবং সংগৃহীত নমুনা বিশ্লেষণ করে ডারউইন অভিব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ মতবাদ প্রকাশ করেন। 1865 খ্রিস্টাব্দে লিখিত “অরিজিন অব স্পিসিস বাই মিন্স অব ন্যাচারাল সিলেকশন” (Origin of Species by Means of Natural Selection ) গ্রন্থে ডারউইন অভিব্যক্তি সম্পর্কে যে মতবাদ প্রকাশ করেন তাকে ‘ডারউইনবাদ’ বা 'প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদ' (Natural Selection Theory) বলে।
ডারউইনবাদের ব্যাখ্যা : কীভাবে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে সে সম্পর্কে ডারউইনের তথ্যগুলির ব্যাখ্যা নিম্নে দেওয়া হল—
1. অত্যধিক জন্মহার (Prodigality of Production) :
পৃথিবীর সকল জীবের প্রজনন হারই খুব বেশি; এরপর যদি জ্যামিতিক হারে বংশানুক্রমে সংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে কয়েক জনুর মধ্যেই একটি জীব থেকে অসংখ্য জীবের সৃষ্টি হয়। যেমন— একটি স্ত্রী স্যালমন মাছ একটি প্রজনন ঋতুতে 2.8 কোটি ডিম পাড়ে। একটি ঝিনুক প্রতি বারে 12 কোটি ডিম পাড়ে। আবার হাতি 12 বছর ছাড়া সন্তান প্রসব করলেও একজোড়া হাতি থেকে উৎপন্ন সব হাতি বেঁচে থাকলে 750 বছরে হাতির সংখ্যা হবে এককোটি নব্বই লক্ষ।
2. সীমিত খাদ্য ও বাসস্থান (Constancy of food and shelter) :
উৎপাদক কর্তৃক উৎপাদিত খাদ্যের পরিমাণ এবং পৃথিবীপৃষ্ঠে জীবের বাসস্থান সীমিত।
3. অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম (Struggle for existance) :
সীমিত খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য প্রজনন হার বেশি হলেও সকল জীব বেঁচে থাকতে পারে না এবং বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন ভাবে সংগ্রাম করতে হয়।
(i) অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম (Intraspecific struggle) : একই প্রজাতির বিভিন্ন জীবের মধ্যে খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য তীব্র সংগ্রাম হয়।
(ii) আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম (Interspecific struggle) : বিভিন্ন প্রজাতির জীবের মধ্যেও খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য সংগ্রাম করতে হয়।
(iii) পরিবেশের সাথে সংগ্রাম (Environmental struggle) : বন্যা, খরা, অত্যধিক ঠান্ডা বা গরম, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে জীবকে বেঁচে থাকতে হয়।
4. প্রকরণ ও বংশগতি (Variation and Heredity) :
ডারউইনের মতে, ত্রিবিধ সংগ্রাম জীবকে বেঁচে থাকার জন্য পরিবর্তিত হতে বাধ্য করে এবং জীবের মধ্যে এমনকি একই পিতামাতার দুটি সন্তানের মধ্যে পার্থক্যযুক্ত বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হয়। একে প্রকরণ বা ভেদ বলে যা অপত্যের দেহে সঞ্চারিত হয়।
5. যোগ্যতমের উদ্বর্তন (Survial of the fittest) :
ডারউইনের মতে,
- (1) জীবের প্রকরণ নির্দিষ্ট পরিবেশে বেঁচে থাকার অনুকূল হলে জীবেরা বাঁচতে পারে। কিন্তু যাদের প্রকরণ বা ভেদগুলি পরিবেশে বেঁচে থাকার সহায়ক নয় তারা কালক্রমে লুপ্ত হয়।
- (2) এইভাবে, 'অনুকূল (বা সহায়ক) ভেদযুক্ত জীবেরা পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হয়ে জীবনসংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়। একেই যোগ্যতমের উদ্বর্তন বলে।
- (3) কিন্তু কোনো পরিবেশের প্রতিকূল ভেদ্য অন্য পরিবেশে জীবের অনুকূল ভেদ হতে পারে।
উদাহরণ—শীতপ্রধান স্থানে বড়ো ও ছোটো লোমওয়ালা কুকুরের মধ্যে কেবল বড় লোমওয়ালা কুকুর বাঁচতে পারে। কিন্তু ছোটো লোমওয়ালা কুকুর গ্রীষ্মপ্রধান স্থানে বাঁচতে পারে।
6. প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection) :
ডারউইনের মতে,
- (1) জীবনসংগ্রামে কোন্ জীব অনুকূল ভেদ লাভ করে বেঁচে থাকবে, অর্থাৎ কীভাবে যোগ্যতমের উদ্বর্তন ঘটবে তা ঠিক করে দেয় প্রকৃতি।
- (2) প্রাকৃতিক নিয়মে অনুকূল ভেদযুক্ত জীবেরা পরিবেশে অভিযোজিত হয়ে বেঁচে থাকার জন্য বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে বেঁচে থাকে। একেই প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে।
উদাহরণ—তৃণ ও বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদের ঘাটতি থাকায় উঁচু উদ্ভিদ থেকে খাদ্য গ্রহণের জন্য লম্বা গলাযুক্ত জিরাফ পরিবেশে বেঁচে থাকার বেশি সুবিধা পেয়ে টিকে আছে।
7. নতুন প্রজাতির উৎপত্তি (Origin of new species) :
অনুকূল প্রকরণগুলি বংশপরম্পরায় অপত্যের মধ্যে পুঞ্জীভূত হতে থাকে এবং একসময় জনিতৃ থেকে বিশেষ পার্থক্যযুক্ত অপত্যের অর্থাৎ নতুন প্রজাতির উৎপত্তি ঘটে।
প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদের ত্রুটি :
- 1. ডারউইন ছোটো ছোটো অস্থায়ী প্রকরণকে গুরুত্ব দিয়েছেন ;কিন্তু ওইগুলি সবসময় বংশগতি লাভ না করায় অভিব্যক্তিতে ভূমিকা থাকে না।
- 2. বড়ো ও স্থায়ী প্রকরণকে (বা মিউটেশান) ‘প্রকৃতির খেলা' বলে উপেক্ষা করছেন।
- 3. দেহকোশ ও জননকোশের প্রকরণের পার্থক্য করতে পারেননি ।
নয়া-ডারউইনবাদ (Neo-Darwinism) :
হেকেল (Hackel), ভাইসম্যান (Weismam), ফিশার (Fisher), হ্যালডেন (Haldane) প্রভৃতি বিজানীরা বংশগতি- বিদ্যা, শ্রেণিবদ্ধবিদ্যা, পরিবেশবিদ্যা, জৈবরাসায়নিকবিদ্যা, জিনতত্ত্ব প্রভৃতির জ্ঞানের দ্বারা ডারউইনের মতবাদকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যাকে নয়া-ডারউইনবাদ বলে। একে আধুনিক সংশ্লেষবাদও (Symthetic Theory) বলা হয়।