হলোজোয়িক পুষ্টি
হলোজোয়িক পুষ্টির পর্যায় (Phases of Holozoic Nutrition)
হলোজোয়িক পুষ্টির পাঁচটি পর্যায়। যথা-খাদ্যগ্রহণ, পরিপাক, শোষণ, আত্তীকরণ ও বহিঃষ্করণ।
1. খাদ্যগ্রহণ (Ingestion):
যে প্রক্রিয়ায় বাহ্যিক উৎস থেকে দেহের ভেতরে খাদ্যবস্তুর অনুপ্রবেশ ঘটে, তাকে খাদ্যগ্রহণ বলে। মানুষ খাদ্যগ্রহণ করে দুটি ওষ্ঠ, জিহ্বা ও দন্তের সাহায্যে। বিভিন্নরকম খাদ্য গ্রহণ ক্রার জন্য অঙ্গগুলির বিভিন্নরকম করিয়া দরকার।
2. পরিপাক (Digestion):
যে প্রক্রিয়ায় উৎসেচকের সক্রিয়তার গৃহীত কঠিন ও জটিল খাদ্য ভেঙে গিয়ে শোষণযোগ্য তরল ও সরল খাদ্যে পরিণত হয় তাকে পরিপাক বলে। মানবদেহের পৌষ্টিকনালির বিভিন্ন অংশে খাদ্যের পরিপাক হয়। মুখবিবরে শুরু হয় এবং ক্ষুদ্রান্তে শেষ হয়।
A. মুখবিবরে পরিপাকঃ
মুখবিবরে খাদ্য প্রবেশ করলে তিনজোড়া লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারস খাদ্যের সাথে মিশ্রিত হয়। [লালাগ্রন্থিগুলি হল-প্যারোটিড (Parotid)-কানের নীচের দিকে; সাবম্যাক্সিলারি (Submaxillary) বা সাম্যান্ডিবুলার-চোয়ালের নীচে এবং সাবলিঙ্গুয়াল (Sublingual)-জিহ্বার তলায় অবস্থিত।] লালারসে কেবল শর্করাভঙ্গক উৎসেচক থাকে। প্রোটিনভঙ্গক ও লিপিডভঙ্গক কোনো উৎসেচক থাকে না। লালারসে টায়ালিন এবং অতি অল্প পরিমাণে মলটেজ নামক শর্করাভঙ্গক উৎসেচক এবং অল্প পরিমাণে লাইসোজোম নামক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী উৎসেচক থাকে। টায়ালিন সেদ্ধ শ্বেতসারকে মলটোজে (80%) পরিণত করে।
অ্যামিবা ক্ষণপদের সাহায্যে, হাইড্রা কর্ষিকার সাহায্যে, কিটোপ্টেরা মুখনিঃসৃত মিউকাস জালের সাহায্যে। মশা চোষকনলের সাহায্যে খাদ্যগ্রহণ করে। অ্যামিবা, স্পঞ্জ প্রভৃতির অন্তঃকোশীয় পরিপাক, মানুষ, ব্যাং প্রভৃতির বহিঃকোশীয় পরিপাক এবং হাইড্রার অন্তঃকোশীয় ও বহিঃকোশীয় উভয় প্রকার পরিপাক দেখা যায়। প্যারোটিড সবচেয়ে বড়ো লালাগ্রন্থি।
B. পাকস্থলীতে পরিপাকঃ
মুখবিবর থেকে লালামিশ্রিত খাদ্যের দলা (bolus) ঐচ্ছিক পেশির সক্রিয়তার গলাধঃকরণের পর পৌষ্টিকনালির অনৈচ্ছিক পেশির ক্রমসংকোচনের (Peristalsis) দ্বারা পাকস্থলীতে পৌঁছোয়।
(a) পাকস্থলীর ভিতরের গাত্রে অবস্থিত পাকগ্রন্থির প্রধান দু-প্রকার কোশ হল-
- (i) অক্সিনটিক (Oxyntic) বা প্যারাইটাল (Parietal) কোশ, যার থেকে HCl (হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড) ক্ষরিত হয় এবং
- (ii) চিফ (Chief) বা পেপটিক (Peptic) কোশ, যার থেকে পেপসিন নামক প্রোটিনভঙ্গক উৎসেচক ক্ষরিত হয়। পেপসিন HCl-এর উপস্থিতিতে প্রোটিনকে ভেঙে পেপটোনে পরিণত করে।
প্রোটিন -> অ্যাসিড মেটাপ্রোটিন -> প্রাইমারি প্রোটিয়েজ -> সেকেন্ডারি প্রোটিয়েজ -> পেপটোন
(b) পাকরসে কোনো শর্করাভঙ্গক উৎসেচক থাকে না। তবে পাকরসে উপস্থিত HCl সুক্রোজকে ভাঙতে পারে।
সুক্রোজ -> গ্লুকোজ + ফ্রুক্টোজ
(c) পাকরসে অল্প পরিমাণে গ্যাস্ট্রিক লাইপেজ নামক লিপিডভঙ্গক উৎসেচক থাকে এবং এটি অ্যাসিড মাধ্যমে তেমন সক্রিয় নয় বলে খুব সামান্য পরিমাণ লিপিড ভাঙে ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারলে পরিণত হয়।
লিপিড -> 3 অণু ফ্যাটি অ্য়াসিড + 1 অণু গ্লিসারল
C. ক্ষুদ্রান্ত্রে পরিপাকঃ
পাকস্থলীর অ্যাসিড মিশ্রিত অর্ধপাচিত খাদ্য অর্থাৎ পাকমন্দ (Chyme) ক্ষুদ্রান্তে প্রবেশ করলে এর সাথে তিনপ্রকার জারকরস মিশ্রিত হয়;
- (i) যকৃতে উৎপন্ন ও পিত্তথলইতে জমে থাকা পিত্তরস।
- (ii) অগ্ন্যাশয় থেকে আগত অগ্ন্যাশয় রস এবং
- (iii) আন্ত্রিক গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত আন্ত্রিক রস।
(i) পিত্তরসের (bile) দ্বারা পরিপাকঃ
- (a) পিত্তরসে কোনো উৎসেচক থাকে না। তবে এতে উপস্থিত ক্ষারপদার্থ পাকস্থলী থেকে আগত অম্লকে প্রশমিত করতে কিছুটা সহায়তা করে ফলে পরবর্তী শর্করা ও প্রোটিন ভঙ্গক উৎসেচকগুলি কাজ করতে পারে।
- (b) আবার, পিত্তরসে উপস্থিত পিত্তলবণ দুটি (সোডিয়াম গ্লাইকোকোলেট ও সোডিয়াম টরোকোলেট) লিপিডের বড়ো বড়ো কণাকে ছোটো ছোটো কণায় ভেঙে লিপিডের অবদ্রব (emulsion) গঠন করে। এর ফলে লিপিডভঙ্গক উৎসেচকগুলি সহজে লিপিডের উপর করিয়া করতে পারে।
(ii) অগ্ন্যাশয় রসের (Pancreatic juice) দ্বারা পরিপাকঃ
(a) অগ্ন্যাশয় রসে অ্যামাইলেজ ও মলটেজ নামে শর্করাভঙ্গক উৎসেচক থাকে। অ্যামাইলেজ সেদ্ধ ও অসেদ্ধ শ্বেতসারকে ভেঙে মলটোজে পরিণত করে।
শ্বেতসার (পলিস্যাকারাইড) -> মলটোজ (ডাইস্যাকারাইড)
মলটেজ মলটোজকে গ্লুকোজে পরিণত করে।
(b) অগ্ন্যাশয় রসে ট্রিপসিন, কাইমোট্রিপসিন প্রভৃতি প্রোটিনভঙ্গক উৎসেচক থাকে। ট্রিপসিন পেপটোনকে বা প্রোটিনকে ভেঙে পেপটাইডে পরিণত করে।
প্রোটিন -> অ্যালকালি মেটাপ্রোটিন -> প্রাইমারি প্রোটিয়েজ -> সেকেন্ডারি প্রোটিয়েজ -> পেপটোন -> পলিপেপটাইড -> লোয়ার পেপটাইড।
কাইমোট্রিপসিন দুগ্ধ প্রোটিনের পরিপাকে সহায়তা করে।
(c) অগ্ন্যাশয় রসে উপস্থিত প্যানক্রিয়েটিক লাইপেজ নামক লিপিডভঙ্গক উৎসেচক লিপিডকে ভেঙে ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারলে পরিণত করে।
লিপিড -> 3 অণু ফ্যাটি অ্যাসিড -> 1 অণু গ্লিসারল
(iii) আন্ত্রিক রসের (Succus entericus) দ্বারা পরিপাকঃ
(a) আন্ত্রিক রসে অ্যামাইলেজ, মলটেজ, সুক্রোজ (ইনভারটেজ), ল্যাকটোজ, আইসোমলটেজ প্রভৃতি শর্করা ভঙ্গক উৎসেচক থাকে। অ্যামাইলেজ সেদ্ধ বা অসেদ্ধ শ্বেতসারকে মলটোজে পরিণত করে।
শ্বেতসার -> মলটোজ
মলটেজ মলটোজকে গ্লুকোজে পরিণত করে।
মলটোজ -> গ্লুকোজ + গ্লুকোজ
সুক্রেজ সুক্রোজকে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজে পরিণত করে।
সুক্রোজ -> গ্লুকোজ + ফ্রুক্টোজ
ল্যাকটেজ ল্যাকটোজকে গ্লুকোজ ও গ্যালাকটোজে পরিণত করে।
ল্যাকটেজ -> গ্লুকোজ + গ্যালাকটোজ
আইসোমলটেজ আইসোমলটোজকে গ্লুকোজে পরিণত করে।
আইসোমলটোজ -> গ্লুকোজ + গ্লুকোজ
(b) আন্ত্রিক রসে উপস্থিত ইরিপসিন নামক প্রোটিনভঙ্গক উৎসেচক পেপটাইডকে অ্যামাইনো অ্যাসিডে পরিণত করে।
পেপটাইডঅ্যামাইনো -> অ্যাসিড
(c) আন্ত্রিক রসে উপস্থিত ইন্টেস্টিনাল লাইপেজ নামক লিপিডভঙ্গক উৎসেচক লিপিডকে ভেঙে ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারলে পরিণত করে।
লিপিড -> 3 অণু ফ্যাটি অ্যাসিড -> 1 অণু গ্লিসারল
এইভাবে ক্ষুদ্রান্ত্রে পরিপাক শেষ হয়।
ছকের মাধ্যমে শর্করা ও প্রোটিনের পরিপাকঃ
পরিপাক স্থান | পরিপাক গ্রন্থি | উৎসেচক | সাবস্ট্রেট | বিক্রিয়ালব্ধ পদার্থ | |
---|---|---|---|---|---|
শর্করা পরিপাক | মুখবিবর | লালাগ্রন্থি | টায়ালিন | সেদ্ধ শ্বেতসার | মলটোজ |
মলটেজ | মলটোজ | গ্লুকোজ | |||
ক্ষুদ্রান্ত্র | অগ্ন্যাশয় | অ্যামাইলেজ | শ্বেতসার | মলটোজ | |
মলটেজ | মলটোজ | গ্লুকোজ | |||
আন্ত্রিক গ্রন্থি | অ্যামাইলেজ | শ্বেতসার | মলটোজ | ||
মলটেজ | মলটোজ | গ্লুকোজ | |||
সুক্রেজ | সুক্রোজ | গ্লুকোজ+ ফ্রুকটোজ | |||
ল্যাকটেজ | ল্যাকটোজ | গ্লুকোজ+গ্যালাক্টোজ | |||
প্রোটিন পরিপাক | পাকস্থলী | পাকগ্রন্থি | পেপসিন | প্রোটিন | প্রোটিয়েজ ও পেপটোন |
ক্ষুদ্রান্ত্র | অগ্ন্যাশয় | ট্রিপসিন | প্রোটিন বা পেপটোন | পেপটাইড | |
আন্ত্রিক গ্রন্থি | ইরিপসিন | পেপটাইড | অ্যামাইনো অ্যাসিড |
3. শোষণ (Absorption):
যে প্রক্রিয়ায় পাচিত তরল ও সরল খাদ্য উপাদান অন্ত্রের আবরণী কলার মাধ্যমে রক্তপ্রবাহে বা লসিকাবাহে প্রবেশ করে, তাকে শোষণ বলে। শোষণ প্রধানত ক্ষুদ্রান্তের প্রাচীরে অবস্থিত অঙ্গুলাকার প্রবর্তক ভিলাই (Villi)-এর মাধ্যমে ঘটে। ভিলাই-এর মধ্যে অবস্থিত রক্তবাহের দ্বারা স্নেহপদার্থ ছাড়া অন্যসকল সরল খাদ্যোপাদান শোষিত হয়। অপরদিকে ভিলাই-এর মধ্যে অবস্থিত লসিকাবাহ পয়স্বিনী (Lacteal) দ্বারা স্নেহপদার্থ শোষিত হয়।
4. আত্তীকরণ (Assimilation):
যে প্রক্রিয়ায় পৌষ্টিকনালি থেকে শোষিত সরল খাদ্য-উপাদান প্রোটোপ্লাজমের অঙ্গীভূত হয়, তাকে আত্তীকরণ বলে। সংবহনের মাধ্যমে বাহিত হয়ে সরল খাদ্যাপাদান কোশে কোশে পৌঁছোয় এবং কোশের মধ্যে বিভিন্ন ক্রিয়ার দ্বারা কোশের অংশে পরিণত হয়।
5. বহিষ্করণ (Egestion):
যে প্রক্রিয়ায় খাদ্যের অপাচিত অংশ বৃহদন্ত্রের মধ্য দিয়ে দেহের বাহিরে নির্গত হয়, তাকে বহিষ্করণ বলে।