ইউক্যারিয়োটিক ক্রোমোজোম
ইউক্যারিয়োটিক ক্রোমোজোমের অঙ্গসংস্থান (Morphology of Eukaryotic Chromosome)
স্থির নিউক্লিয়াসে ক্রোমোটিন সূত্র প্রসারিত থাকে। কোশবিভাজনের সময় বিশেষ করে মেটাফেজ দশায় ওই ক্রোমোটিন সূত্র সবচেয়ে স্থূল প্যাঁচানো ও দণ্ডাকার হয়। এই অবস্থায় ক্রোমোজোমকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। একটি আদর্শ ক্রোমোজোমের অংশগুলি নিম্নরূপ।
1. মুখ্য খাঁজ (Primary Constriction) :
ক্রোমোজোম দেহের বিশেষ একটি স্থানে যে খাঁজ থাকে এবং যার মধ্যে সেন্ট্রোমিয়ার অবস্থান করে তাকে মুখ্য খাঁজ বলে ৷
2. সেন্ট্রোমিয়ার (Centromere) :
মুখ্য খাঁজ অংশে অবস্থিত যে ক্রোমোটিন অংশ কোশবিভাজনের সময় কাইনেটোকোর নামক প্লেটসদৃশ অংশের দ্বারা বেমতন্তুর সাথে যুক্ত থাকে, তাকে সেন্ট্রোমিয়ার বলে।
সেন্ট্রোমিয়ারের সংখ্যা অনুসারে ক্রোমোজোমগুলি অ্যাসেন্ট্রিক (সেন্ট্রোমিয়ার- বিহীন), মনোসেন্ট্রিক (এক ন্ট্রোমিয়ারযুক্ত), ডাইসেন্ট্রিক (দুই সেন্ট্রোমিয়ারযুক্ত), পলি- সেন্ট্রিক (বহু সেন্ট্রোমিয়ার- যুক্ত) এবং হলোসেন্ট্রিক (সারা ক্রোমোজোম জুড়ে সেন্ট্রোমিয়ার থাকে)। আবার সেন্ট্রোমিয়ারের অবস্থান অনুযায়ী ক্রোমোজোম চার প্রকারের হয়। যথা— মেটাসেন্ট্রিক (সেন্ট্রোমিয়ার মাঝখানে), সাবমেটাসেন্ট্রিক (সেন্ট্রোমিয়ার মাঝের কাছা- কাছি), অ্যাক্রোসেন্ট্রিক (সেন্ট্রো- মিয়ার প্রান্তের কাছাকাছি) ও টেলোসেন্ট্রিক (সেন্ট্রোমিয়ার প্রান্তে)।
3. বাহু (Arm) :
সেন্ট্রোমিয়ার অংশ ছাড়া ক্রোমোজোমের বাকি অংশকে বাহু বলে।
4. ক্রোমাটিড (Chromatid) :
ক্রোমোজোমের বাহু লম্বালম্বি যে দুটো সমান আকৃতির সুতোর মতো অংশ নিয়ে গঠিত তাদের ক্রোমোটিড বলে।
বিভাজনক্ষম কোশের ইন্টারফেজ দশায় ও প্রোফেজ দশায় ক্রোমোটিড দুটি অত্যন্ত সরু সুতোর মতো হয় এবং তখন এদের ক্রোমোনিমা বলে। তখন এরা আলগাভাবে (প্যারানেমিক) অথবা দৃঢ়ভাবে (প্লেক্টোনেমিক) কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে।
পূর্বে মনে করা হত প্রতিটি ক্রোমাটিডে 2টি বা তার বেশি ক্রোমোনিমা আছে।
5. ক্রোমোমিয়ার (Chromomere) :
ইন্টারফেজ দশায় এবং মিয়োসিস কোশবিভাজনের প্রোফেজ দশায় ক্রোমোনিমার সাথে স্থূল গোলাকার দানা পুঁতির মালার মতো অবস্থান করতে দেখা যায়, যেগুলিকে ক্রোমোমিয়ার বলে।
6. গৌণ খাঁজ (Secondary Constriction) :
কোশের কিছু ক্রোমোজোমে (সাধারণত একজোড়া ক্রোমোজোমে) মুখ্য খাঁজ ছাড়াও আর-একটি খাঁজ থাকে যেখানে নিউক্লিয়োলাস উৎপন্ন হয় ও যুক্ত থাকে। এই খাঁজকে গৌণ খাঁজ বা নিউক্লিয়োলার অর্গানাইজার বলে। এই অংশ কাইনেটোকোর থাকে না ।
7. স্যাটেলাইট (Satellite ) :
গৌণ খাঁজ ক্রোমোজোমের প্রান্তের দিকে থাকলে; গৌণ খাঁজের পরবর্তী ক্রোমোজোমের ক্ষুদ্র গোলাকার অংশকে স্যাটেলাইট বলে।
8. টেলোমিয়ার (Telomere) :
বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত ক্রোমোজোমের প্রান্তগুলিকে টেলোমিয়ার বলে, যা কোশবিভাজন নিয়ন্ত্রণ করে।
ইউক্যারিয়োটিক ক্রোমোজোমের রাসায়নিক উপাদান (Chemical composition of Eukaryotic Chromosome)
ক্রোমোজোমের রাসায়নিক উপাদানগুলি হল –
- (A) নিউক্লিক অ্যাসিড (প্রায় 40%),
- (B) প্রোটিন (প্রায় 60%) এবং
- (C) অতি অল্প ধাতব আয়ন (প্রায় 0.5%)।
A. নিউক্লিক অ্যাসিড দু-প্রকারের থাকে, যথা—
- (1) ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড বা DNA এবং
- (2) রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড বা RNA। ক্রোমোজোমে DNA ও RNA-এর অণুপাত 10 : 1।
B. প্রোটিন দু-প্রকারের থাকে, যথা—
- (1) ক্ষারীয় হিস্টোন প্রোটিন ও
- (2), অম্লীয় অহিস্টোন প্রোটিন। পাঁচ প্রকারের হিস্টোন প্রোটিন থাকে। যথা—HI, H2a, H2b, H3 ও H4। হিস্টোন ও অহিস্টোন প্রোটিনের অনুপাত 10 : 6।
C. ধাতব আয়ন বিভিন্ন প্রকারের থাকে। যথা- Mg++,Ca++, Fe++ প্রভৃতি।
দ্বিতন্ত্রী DNA এবং হিস্টোন প্রোটিন- একসাথে যুক্ত হয়ে বহু নিউক্লিয়োজোম (Nucleosome) নামে দানার মতো অংশ গঠন করে।
এইরূপ নিউক্লিয়োজোমযুক্ত সরু ক্রোমাটিন তত্ত্ব (10 nm) লুপ গঠন করে ও কুণ্ডলীকৃত হয়ে উন্নত প্যাকেজিং-এর ফলে ক্রোমোজোম গঠন করে। এইরূপ ধারণাকে সুপার সলিনয়েড মডেল বলে।
DNA-এর গঠন বা জিনের রাসায়নিক গঠন :
DNA একপ্রকার বৃহৎ জৈব অণু যা বহু ক্ষুদ্র একক নিয়ে গঠিত। এই এককগুলিকে নিউক্লিয়োটাইড (Nucleotide) বলে। প্রতিটি নিউক্লিয়োটাইডের তিনটি অংশ, যথা-
- (1) নাইট্রোজেন বেস,
- (2) পেন্টোজ শর্করা ও
- (3) ফসফেট।
নিউক্লিয়োটাইডের ফসফেট ছাড়া বাকি অংশকে নিউক্লিয়োসাইড (Nucleoside) বলে ।
- (1) নাইট্রোজেন বেস মোট চারপ্রকারের থাকে। এর মধ্যে অ্যাডেনিন (A) ও গুয়ানিন (G)-কে পিউরিন এবং সাইটোসিন (C) ও থাইমিন (T)-কে পিরিমিডিন জাতীয় যৌগ বলে।
- (2) পেন্টোজ শর্করাটি একটি পাঁচ কার্বনযুক্ত ডিঅক্সিরাইবোজ শর্করা।
- (3) ফসফেটটি ফসফোরিক অ্যাসিড রূপে থাকে।
ওয়াটসন ও ক্রিক (Watson and Crick, 1953)-এর মডেল অনুসারে DNA অণু দ্বিতন্ত্রী (Double helix) এবং এটি লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ির মতো। এই সিঁড়ির হাতল শর্করা ও ফসফেট দিয়ে তৈরি এবং ধাপগুলি নাইট্রোজেন বেস দিয়ে তৈরি। DNA-এর প্রতিটি তন্ত্রী গঠিত হয় পরপর বহু নিউক্লিয়োটাইড যুক্ত হয়ে। পাশাপাশি দুটি তন্ত্রীর নাইট্রোজেন বেসগুলি হাইড্রোজেন বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে। সবসময় অ্যাডিনিন (A) ও থাইমিন (T) পাশাপাশি অবস্থান করে এবং দুটি হাইড্রোজেন বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে এবং গুয়ানিন (G) ও সাইটোসিন (C) পাশাপাশি অবস্থান করে ও তিনটি হাইড্রোজেন বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে। দ্বিতন্ত্রী কুণ্ডলীর ব্যাস 20A0 এবং একটি সম্পূর্ণ প্যাচের দৈর্ঘ্য 37A0 হয়।
RNA-এর গঠন :
RNA-এর একটিমাত্র তন্ত্রী থাকে। এতে থাইমিন থাকে না, পরিবর্তে ইউরাসিল থাকে এবং শর্করাটি হল রাইবোজ শর্করা।
DNA ও RNA-এর পার্থক্য
নং | DNA | RNA |
---|---|---|
১ | DNA দ্বিতন্ত্রী এবং সর্পিলাকার। | RNA একতন্ত্রী এবং রেখাকার। |
২ | এতে ডিঅক্সি রাইবোজ শর্করা থাকে। | এতে রাইবোজ শর্করা থাকে। |
৩ | এর নাইট্রোজেন বেসগুলি হল অ্যাডোনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন ও থাইসিন । | এর নাইট্রোজেন বেসগুলি হল অ্যাডোনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন ও ইউরাসিল। |
৪ | জিন বহন করে। | জিন বহন করে না (RNA ভাইরাস ছাড়া)। |