বাহকের দ্বারা সৃষ্ট রোগ
বাহকের দ্বারা সৃষ্ট রোগ (Disease caused by carriers)
বাহক কী (What is carrier?)
যেসকল প্রাণী সরাসরি মানুষ বা অন্য প্রাণীর সাথে সংস্পর্শের দ্বারা অথবা খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগজীবাণুকে আক্রান্ত দেহ থেকে সুস্থ দেহে সংক্রামিত করে তাদের বাহক বলে।
1. বাহক হিসাবে গৃহমাছি (Housefly as a carrier) :
গৃহমাছি বা মক্ষিকা বা মুসকা ডোমেস্টিকা (Musca domestica) একটি পতঙ্গ যার পা ও দেহ লোমযুক্ত। গোবর, পচা আবর্জনা প্রভৃতির উপর একসাথে 100–150টি সাদা রং-এর ডিম পাড়ে, যেগুলি 12-24 ঘণ্টায় ম্যাগট নামে পা-হীন লার্ভায় পরিণত হয় । লার্ভা থেকে 5–6 দিন পর পিউপা এবং পিউপা থেকে 4–5 দিন পর পূর্ণাঙ্গ মাছি উৎপন্ন হয়।
⚫গৃহমাছি কী কী রোগ ছড়ায়?
কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয়, উদরাময়, ট্রাকোমা, অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা প্রভৃতি ।
⚫কীভাবে গৃহমাছি রোগ ছড়ায়?
বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মল, মূত্র, কফ, থুথু, লালা, চোখের পিঁচুটি প্রভৃতির ওপর বসলে মাছির পা, ডানা, মুখ-উপাঙ্গ প্রভৃতিতে রোগজীবাণু আটকে থাকে। এরপর মাছি খাদ্যের ওপর বসে বারবার পা ঘষে, ডানা ও শুঁড় নাড়ে, ঘন ঘন বমন ও মলত্যাগ করে। ফলে খাদ্য বিভিন্ন রোগজীবাণুর দ্বারা সংক্রামিত হয় এবং ওই খাদ্য সুস্থ ব্যক্তি গ্রহণ করলে তার রোগ হয়।
⚫মাছিবাহিত রোগদমনের উপায় :
▶A. মাছির ডিম ও লার্ভা দমন :
- (i) মল, গোবর, পচা উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রভৃতি যেসকল পদার্থের উপর মাছি ডিম পাড়ে সেগুলিকে আশেপাশে না ফেলা।
- (ii) গোবর বা বাড়ির আবর্জনা ঢাকনাযুক্ত পাত্রে ফেলা।
- (iii) ফিনাইল, ক্রিসল, কার্বলিক অ্যাসিড প্রভৃতি 'রাসায়নিক পদার্থ মাছির ডিম পাড়ার স্থানে ছড়ানো।
▶B. পূর্ণাঙ্গ মাছি দমন :
- (i) সরু তারের ফাদ দ্বারা ;
- (ii) রেড়ির তেল ও রজন-এর মিশ্রণে তৈরি আঠা কাগজে লাগিয়ে ;
- (ii) ফর্মালিন, পাইরেথিয়াম প্রভৃতি মিষ্টদ্রব্যে মিশিয়ে ;
- (iv) পেট্রলধোঁয়া ও মাছিমারা যন্ত্রের দ্বারা মাছিকে দমন করা হয়।
▶C. অন্যান্য উপায় :
- (i) শৌচাগারে ও প্রস্রাবাগারে ছাড়া অন্যত্র মলমূত্র ত্যাগ না করা এবং যত্রতত্র কফ, থুথু না ফেলা।
- (ii) খাবার সর্বদা ঢেকে রাখা অথবা সূক্ষ্ম তার জাল ঘেরা স্থানে রাখা।
- (iii) রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট ঔষধ খাওয়ানো।
2. বাহক হিসাবে মশা (Mosquito as a carrier) :
মশাও একপ্রকার পতঙ্গ। স্ত্রীমশার শোষণযন্ত্র (প্রোবোসিস) সূচোলো। মশকী বদ্ধ নোংরা জলে (কিউলেক্স) বা পরিষ্কার জলে (অ্যানোফিলিস) ডিম পাড়ে। 2-3 দিন পর ডিম থেকে লার্ভা বের হয়। 5-10 দিনের মধ্যে চারটি ইনস্টার দশা অতিক্রম করে কমা আকৃতির পিউপা উৎপন্ন হয়। 2-3 দিন পর পিউপা পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হয়।
⚫বিভিন্ন মশকীর দ্বারা বাহিত রোগ :
▶(a) অ্যানোফিলিস স্টিফেনসি (Anopheles stephensi) ছড়ায় ম্যালেরিয়া। ▶(b) কিউলেক্স ফ্যাতিগ্যানস্ (Culex fatigans) ছড়ায় ফাইলেরিয়া (Filaria) এবং এনকেফেলাইটিস (encephalitis)। ▶(c) এডিস ইজিপ্টি (Aedes aegypti) ছড়ায় ডেঙ্গুজ্বর ও পীতজ্বর।⚫কীভাবে মশা রোগ ছড়ায়?
বিভিন্নপ্রকার স্ত্রী মশা যখন রোগাক্রান্ত (ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, পীতজ্বর প্রভৃতি রোগে) মানুষ বা অন্য প্রাণীর দেহ থেকে রক্তপান করে তখন মশকীর দেহে সংশ্লিষ্ট রোগের জীবাণু প্রবেশ করে। এরপর ওই মশকী সুস্থ ব্যক্তির দেহে রক্তপান করার সময় মশকীর দেহ থেকে সুস্থ ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করে রোগসংক্রমণ ঘটায়। মশকী সরাসরি রোগজীবাণুকে এক দেহ থেকে অন্য দেহে বহন করে (প্রত্যক্ষ সংক্রমণ) অথবা নিজদেহে বহন করে ও পরে লালার মাধ্যমে সুস্থদেহে প্রবেশ করায় (জৈবিক সংক্রমণ)। (পরোক্ষ সংক্রমণ) অথবা নিজদেহে জীবাণুর বিস্তার ঘটায় ও সুস্থদেহ সংক্রামিত করে
⚫মশাবাহিত রোগদমনের উপায় :
▶A. মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা :
- (i) ছোটো ছোটো ডোবা ভরাট করা।
- (ii) নর্দমা পরিষ্কার রাখা।
- (iii) আবদ্ধ পাত্রের জল নির্দিষ্ট সময় অন্তর পালটে দেওয়া।
▶B. মশার লার্ভা ধ্বংস করা :
- (i) কেরোসিন বা পেট্রল প্রজননস্থলের জলে ঢেলে দেওয়া।
- (ii) DDT, পানামা লার্ভা নাশক (জল, কস্টিক সোডা, রেজিন ও ফেনল) প্রভৃতি কীটনাশক ছড়ানো।
- (iii) তেচোখা, তেলাপিয়া প্রভৃতি মাছকে মশার প্রজনন ক্ষেত্রে চাষ (যারা মশার লার্ভা ভক্ষণ করে) করা।
▶C পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংস করা :
(i) মশার আবাসস্থলে DDT, ডাই এলড্রিন, সালফার ডাইঅক্সাইড ধোঁয়া ছড়ানো।
▶D. চিকিৎসা : মশাবাহিত রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
▶E আত্মরক্ষা : মশার দংশন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মশারি ব্যবহার করা, ওডোমস প্রভৃতি ক্রিম মাখা, ক্রিয়োজোট দিয়ে দেয়াল রং করা, মশক নিবারক ধুপ জ্বালানো বা মশক বিতাড়ক আলট্রাসোনিক যন্ত্র ব্যবহার করা।