বৃক্ক
বৃক্ক (Kidney):
শিমবীজের মতো আকৃতির, কালচে লালবর্ণের ক্যাপসুল নামক আবরণ দ্বারা আবৃত বৃক্কদুটি নিম্ন উদরের পৃষ্ঠদেশে পেরিটোনিয়াম পর্দায় আবদ্ধ অবস্থায় ঝুলে থাকে। বৃক্কের অবতল অংশ বা হাইলামের সাথে শিরা, ধমনি ও গবিনী যুক্ত থাকে। প্রতিটি বৃক্কের ওজন প্রায় 125-170 gm; আয়তন 11cm×6cm×3cm।
বৃক্কের লম্বচ্ছেদের পরিধির দিকে গাঢ় লালবর্ণের দানাময় অংশকে কর্টেক্স এবং কেন্দ্রের দিকে গোলাপি বর্ণের অংশকে মেডালা বলে। বৃক্কের গঠনগত ও কার্যগত একক নেফ্রন প্রধানত কর্টেক্স অঞ্চলে (85%) থাকে। মেডালাতে আট থেকে আঠারোটি শঙ্কুর মতো গঠন (বৃক্কীয় পিরামিড) থাকে যার মধ্যে সংগ্রাহী নালি, বেলিনির নালি রক্তবাহ প্রভৃতি থাকে। ২-৩টি পিরামিডের সূচালো অংশ থেকে মাইনর ক্যালিক্স এবং কয়েকটি মাইনর ক্যালিক্স একত্রে মেজর ক্যালিক্স গঠন করে। 4-5 টি মেজর ক্যালিক্স একত্রে যুক্ত হয়ে গবিনীর পেল্ভিস অঞ্চল গঠন করে।
বৃক্কের গঠনগত ও কার্যগত এককরূপে মানুষের নেফ্রন (Human nephron as structural and functional unit of kidney):
ম্যালপিজিয়ান কণিকা ও বৃক্কীয় নালি দ্বারা গঠিত বৃক্কের গঠনগত ও কার্যগত একককে নেফ্রন বলে। প্রতিটি বৃক্কে প্রায় 10 লক্ষ নেফ্রন থাকে। প্রতিটি নেফ্রন প্রায় 40 mm দীর্ঘ।
নেফ্রনের প্রধান দুটি অংশ থাকে, যথা-(1) ম্যালপিজিয়ান কণিকা ও (2) বৃক্কীয় নালিকা
1)ম্যালপিজিয়ান কণিকা (Malpighian corpuscles):
বৃক্কের কর্টেক্স অঞ্চলে অবস্থিত নেফ্রনের স্ফীত প্রান্তীয় অংশটিকে ম্যালপিজিয়ান কণিকা বলে। এর দুটি অংশ (a) বাওম্যান ক্যাপসুল (b) গ্লোমেরুলাস।
a)বাওম্যান ক্যাপসুল (Bowman’s Capsule):
এটি গোল ফানেলের মতো দুটো একক কোশস্তরযুক্ত নেফ্রনের বদ্ধপ্রান্ত, যা গ্লোমেরুলাসকে আবৃত করে রাখে। এর বাইরের স্তরকে প্যারাইটাল স্তর এবং ভিতরের গ্লোমেরুলাসের দিকের স্তরকে ভিসেরাল স্তর বলে। ভিসেরাল স্তরে পোডোসাইট (Podocyte) নামে তারকাকৃতি কোশগুলি জালকের আকারে থাকে। মাঝের ছিদ্রগুলিকে স্লিটপোর (Slit Pore) বলে।
কাজঃ গ্লোমেরুলাস পরিস্রুত তরল গ্রহণ করে বৃক্কীয় নালিকায় পাঠায়।
b)গ্লোমেরুলাস (Glomerulus):
এটি বাওম্যান ক্যাপসুলের অভ্যন্তরে অবস্থিত প্রায় 50টি লুপের মতো রক্তজালক নিয়ে গঠিত। গ্লোমেরুলাসের মধ্যে মোটা অন্তর্মুখী (Afferent) ধমনিকা দিয়ে রক্ত প্রবেশ করে এবং সরু বহির্মুখী (Efferent) ধমনিকা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে যায়।
কাজঃ গ্লোমেরুলাস রেচনপদার্থসহ রক্তের তরল অংশের পরা-পরিস্রাবণ (Ultrafiltration) ঘটিয়ে বাওম্যান ক্যাপসুলে পাঠায়।
2)বৃক্কীয় নালিকা (Real tubules):
বাওম্যান ক্যাপসুলের থেকে শুরু হয়ে সংগ্রাহী নালি পর্যন্ত বিস্তৃত নলাকার অংশকে বৃক্কীয় নালিকা বলে।
এর প্রধান চারটি অংশ নিম্নরূপঃ
নিকটবর্তী সংবর্ত বা পরসংবর্তনালিকা (Proximal Convoluted tubules): এটি বাওম্যান ক্যাপসুল সংলগ্ন কুন্ডলীকৃত নালিকা।
কাজ- এই অংশে গ্লুকোজ, অ্যামাইনো অ্যাসিড, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফেট, সালফেট, কার্বনেট, ক্রিয়োটিন, ইউরিক অ্যাসিড প্রভৃতির পুনঃবিশোষণ (Reabsorption) ঘটে (রক্তজালক দ্বারা)।
হেনলির লুপ (Loop of Henle): এটি নিকটবর্তী সংবর্তনালির পরে ‘U’ আকৃতির নলাকার অংশ। এর পরপর অংশগুলি হল-(i) নিম্নগামী মোটা অংশ (ii) নিম্নগামী সরু অংশ (iii) ঊর্ধ্বগামী সরু অংশ ও (iv) ঊর্ধ্বগামী মোটা অংশ।
কাজ- এই অংশে জল, সোডিয়াম, ক্লোরিন প্রভৃতির পুনঃবিশোষণ ঘটে।
দূরবর্তী সংবর্ত বা দূরবর্তী নালিকা (Distal convoluted tubule): এটি সংগ্রাহী নালিসংলগ্ন কুণ্ডলীকৃত নালিকা অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী ধমনির যে অংশের সাথে যুক্ত তাকে জাক্স্ট্রাগ্লোমেরিউলার অ্যাপারেটাস বলে।
কাজ- জল ও সোডিয়ামের পুনঃবিশোষণ এবং অ্যামোনিয়া, পটাশিয়াম প্রভৃতির ক্ষরণ ঘটায়।
সংগ্রাহী নালি (Collecting tubules): দূরবর্তী সংবর্ত নালি যে মোটা নালির সাথে যুক্ত থাকে তাকে সংগ্রাহী নালি বলে।
কাজ- জল, লবণ ও রেচনপদার্থকে (মূত্ররূপে) দূরবর্তী সংবর্ত নালি থেকে গ্রহণ করে বেলিনীর নালিতে পাঠায়।
বৃক্কের মাধ্যমে রেচন বা মূত্র উৎপাদন (Excretion through Kidney or Urine formation)
বৃক্কের নেফ্রনের মাধ্যমে দেহের অপ্রয়োজনীয় জল, বিপাকজাত ক্ষতিকারক পদার্থ (N2 -যুক্ত ও N2 -বিহীন) এবং অপ্রয়োজনীয় জৈব ও অজৈব যৌগ রক্ত থেকে আলাদা হয়ে মূত্রে পরিণত হয়।
বিজ্ঞানী বাওম্যান (Bowman), স্ট্যার্লিং (Sterling), কুশনি (Cushney) প্রভৃতি বিজ্ঞানীর মতে মূত্র উৎপাদন নিম্নলিখিত চারটি পর্যায়ে ঘটে-
গ্লোমেরুলাস দ্বারা পরিস্রাবণ (Filtration):
গ্লোমেরুলাস পরিস্রাবক যন্ত্র হিসাবে কাজ করে। অন্তর্মুখী ধমনিকার চেয়ে বহির্মুখী ধমনিকার ব্যাস কম হওয়ায় গ্লোমেরুলাসে রক্তের চাপ বেশি হয় (কার্যকরী পরিস্রাবণ চাপ 10mm-30mm Hg)। এর ফলে রক্তের বৃহৎ কোলয়েড অনু (প্রোটিন, লিপিড ও রক্তকণিকা) ছাড়া প্রায় সকল অংশ পরিশ্রুত হয়ে বাওম্যান ক্যাপসুলের গহ্বরে প্রবেশ করে। একে পরা-পরিস্রাবণ (Ultrafiltration) বলে। প্রতিদিন 170 লিটার গ্লোমেরুলাস পরিস্রুত তরল সৃষ্টি হয়।
বৃক্কীয় নালিকার দ্বারা পুনঃশোষণ (Reabsorption):
দেহের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদান, যেমন-গ্লুকোজ, অ্যামাইনো অ্যাসিড, অ্যাসকরবিক অ্যাসিড। প্রভৃতি সম্পূর্ণভাবে পুনঃশোষিত হয়। এছাড়া বেশিরভাগ জল এবং কিছু পরিমাণে Na+, K+, ফসফেট , সালফেট, ইউরিয়া ও ইউরিক অ্যাসিডও পুনঃশোষিত হয়। প্রতিদিন 168.5 লিটার জলীয় পদার্থ এভাবে পুনঃশোষিত হয়। জলের পুনঃশোষণে ADH (অ্যান্টি ডাইইউরেটিক হরমোন) সহায়তা করে।
বৃক্কীয় নালিকার ক্ষরণ (secretion):
বৃক্কীয় নালিকার কোশ থেকে বিভিন্ন বস্তু যেমন-রেনিন, এরিথ্রোজেনিন, সালফেট, কোলিন, হিস্টামিন প্রভৃতি বৃক্কীয় নালিকার অভ্যন্তরে ক্ষরিত হয়।
নেফ্রন দ্বারা নূতন বস্তুর সংশ্লেষ (Manufacture of new substances):
বৃক্কীয় নালিকার কোশগুলি অ্যামোনিয়া, হিপ্পিউরিক অ্যাসিড, অজৈব ফসফেট প্রভৃতি উৎপন্ন করে, যেগুলি মূত্রের মাধ্যমে রেচিত হয়।
এইভাবে পরিস্রাবণ ও পুনঃশোষণের পর ক্ষরিত ও উৎপাদিত পদার্থসহ প্রতিদিন প্রায় 1.5 লিটার মূত্র সংগ্রাহী নালি ও গবিনীর মাধ্যমে দেহের বাহিরে বেরিয়ে যায়।
বৃক্ক ছাড়া অন্যান্য রেচন অঙ্গ (Excretory Organs except kidney):
ত্বক (Skin): ত্বকে অবস্থিত ঘর্মগ্রন্থির থেকে ঘর্ম (sweat) নিঃসৃত হয়। ঘর্মের মাধ্যমে জল, NaCl, ইউরিয়া, ইউরিক অ্যাসিড, CO2 এবং আরও বিভিন্ন লবণ দেহের বাইরে রেচিত হয়।
ফুসফুস (Lungs): ফুসফুসের থেকে নিশ্বাস বায়ুর মাধ্যমে কার্বন ডাইঅক্সাইদ ও কিছু জল দেহের বাইরে বেরিয়ে যায়।
যকৃৎ (Liver): যকৃতের মাধ্যমে হিমোগ্লোবিন ভেঙে উৎপন্ন বিলিরুবিন, বিলিভারডিন, স্টারকোবিলিনোজেন এবং বিভিন্ন ভারী ধাতু, প্রতিবিষ (Toxin), লেসিথিন, কোলেস্টেরল প্রভৃতি মলের সাথে রোচিত হয়। এছাড়া যকৃতে অরনিথিন চক্রের মাধ্যমে ইউরিয়া তৈরি হয়।
লালাগ্রন্থি (salivary glands): লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারসের মাধ্যমে ইউরিয়া, আয়োডাইড, থায়োসায়ানেট, কোহল প্রভৃতি রোচিত হয়।
অন্ত্র (Intestine): অন্ত্রের ভিতরের আবরণ থেকে লৌহ ও ক্যালশিয়াম লবণ অন্ত্রের গহ্বরে নিষ্কাশিত হয়ে মলের সাথে রোচিত হয়।