প্রতিবর্ত ক্রিয়া
প্রতিবর্ত ক্রিয়া (Reflex action) :
মস্তিষ্কের বিচারবিশ্লেষণ ছাড়াই অতি দ্রুত বহু উদ্দীপনার প্রতিক্রিয়া ঘটে এবং সেগুলি প্রধানত সুষুম্নাকাণ্ডের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন, চোখে কিছু পড়ার উপক্রম হলে চোখের পাতা বন্ধ হয় ; পায়ের পাতায় হঠাৎ কাঁটা বিঁধলে পায়ের পাতা দ্রুত সরে যায় প্রভৃতি। এগুলিকে প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে। বিজ্ঞানী শেরিংটন (1789) প্রথম 'প্রতিবর্ত ক্রিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করেন।
সংজ্ঞা (Definition) :
বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ গ্রাহকের দ্বারা গৃহীত সংজ্ঞাবহ উদ্দীপনা স্নায়ুতন্ত্রে প্রবেশ করে অতি দ্রুততার সাথে প্রাণীর ক্রিয়া অঙ্গে যে স্বতঃস্ফূর্ত ও অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তাকে প্রতিবর্ত ক্রিয়া বা রিফ্লেক্স অ্যাকসন বলে।
প্রতিবর্ত চাপ (Reflex arc) :
যে নির্দিষ্ট স্নায়ুপথে প্রতিবর্ত ক্রিয়ার স্নায়ুস্পন্দন সংবাহিত হয়, তাকে প্রতিবর্ত চাপ বা বিফ্লেক্স আর্ক বলে।
প্রতিবর্ত চাপ সরল অথবা জটিল হয়। সরল প্রতিবর্ত চাপ সাইন্যাপস-এর উপস্থিতি অনুসারে (i) সন্নিধিবিহীন, (ii) এক-সন্নিধি, (iii) দ্বি-সন্নিধি, (iv) বহুসন্নিধি প্রভৃতি হয়। এবং এগুলি কেবল সুষুম্নাকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকে। কিন্তু জটিল প্রতিবর্ত চাপ সুষুম্নাকাণ্ড ও মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত এবং এতে বহু সাইন্যাপস থাকে।একটি সরল প্রতিবর্ত চাপের বিভিন্ন অংশ :
একটি সরল প্রতিবর্ত চাপ পাঁচটি অংশ নিয়ে গঠিত। যথা—
(1) গ্রাহক (Receptor) : উদ্দীপনা গ্রহণ করতে পারে এরকম বিশেষ পরিবর্তিত কোশ বা অঙ্গ।
(2) অন্তর্বাহী নিউরোন-(Afferent neurone): এটি গ্রাহক থেকে উদ্দীপনা গ্রহণ করে স্নায়ুকেন্দ্রে (সুষুম্নাকাণ্ড) পাঠায়।
(3) স্নায়ুকেন্দ্র (Nerve center) : এটি সুষুম্নাকাণ্ডের স্নায়ুকোশসমৃদ্ধ ধূসর বস্তু, যেখানে সংজ্ঞাবহ স্নায়ুপ্রবাহ চেষ্টীয় স্নায়ুপ্রবাহে পরিণত হয়।
(4) বহির্বাহী নিউরোন (Efferent neourone) : এটি স্নায়ুকেন্দ্র থেকে স্নায়ুপ্রবাহকে কারকে প্রেরণ করে।
(5) কারক (Effector) : কারক হল বিভিন্ন পেশি ও গ্রন্থি যেগুলি বহির্বাহী নিউরোন দ্বারা প্রেরিত স্নায়ুপ্রবাহে উদ্দীপিত হয়ে সাড়া দেয়।
প্রতিবর্ত ক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ (Classification of Reflex action ) :
A. প্রকৃতি অনুসারে প্রতিবর্ত ক্রিয়াকে রুশ বিজ্ঞানী প্যাভলভ দু-ভাগে ভাগ করেছেন। যথা–
1. সহজাত বা অনপেক্ষ বা শর্তবিহীন প্রতিবর্ত (Inborn or unconditiond reflex) :
যেসকল প্রতিবর্ত জন্মের সঙ্গে প্রাপ্ত, চিরস্থায়ী এবং শর্তনিরপেক্ষ, তাদের সহজাত প্রতিবর্ত বলে।
যেমন—তীব্র আলোকে চোখ বন্ধ হওয়া; শিশুর মাতৃস্তন পান; খাদ্যর স্বাদে লালাক্ষরণ; হাঁটুর মালাইচাকির নীচে মৃদু আঘাতে পায়ের ঝাঁকুনি প্রভৃতি।
গ্রাহকের অবস্থান অনুসারে এটি বিভিন্ন প্রকারের, যেমন—
(i) উপরিগত প্রতিবর্ত : এইপ্রকার প্রতিবর্তের গ্রাহকগুলি দেহের উপরিভাগে থাকে। উদাঃ-পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিলে পায়ের আঙুল নীচের দিকে বেঁকে যায়।
(ii) গভীর প্রতিবর্ত : এইপ্রকার প্রতিবর্তের গ্রাহকগুলি দেহের গভীরে কোনো পেশি বা টেনডনে অবস্থিত। উদাঃ—হাঁটু ঝাঁকুনি।
(iii) আন্তরযন্ত্রীয় প্রতিবর্ত : উদাঃ—আলোর প্রভাবে চোখের মণির সংকোচন।
(iv) বিকারতাত্ত্বিক প্রতিবর্ত : উদাঃ—অসুস্থ অবস্থায় মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি।
2. সাপেক্ষ বা অভ্যাসনির্ভর প্রতিবর্ত (Conditioned or aquired reflex) :
যেসকল প্রতিবর্ত বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে ক্রমাগত অভ্যাস বা অভিজ্ঞতার দ্বারা অর্জিত এবং যা জন্মগত ও চিরস্থায়ী নয়, তাকে সাপেক্ষ বা অভ্যাসনির্ভর প্রতিবর্ত বলে।
যেমন—হাঁটাচলা, সাইকেল চালানো, পরিচিত সুস্বাদু খাদ্যের গন্ধে বা দর্শনে লালাক্ষরণ প্রভৃতি।
প্যাভলভের পরীক্ষা : বিজ্ঞানী প্যাভলভ একটি কুকুরকে প্রত্যহ নির্দিষ্ট সময়ে ঘণ্টা বাজিয়ে খাবার দিতেন। কিছুদিন এভাবে চলার পর তিনি দেখলেন খাবার না দিয়ে কেবল ঘণ্টা বাজালেই কুকুরের লালাক্ষরণ ঘটতে পারে। এটি শর্তসাপেক্ষ প্রতিবর্তের একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
B. ক্রিয়াগত জটিলতা অনুসারে প্রতিবর্ত দু-প্রকারের হয়। যথা—
1. সরল প্রতিবর্ত : যেসকল প্রতিবর্ত কেবলমাত্র সুষুম্নাকাণ্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং যার প্রতিবর্ত চাপ অল্পসংখ্যক নিউরোন দ্বারা গঠিত, তাকে সরল প্রতিবর্ত বলে। যেমন—হাঁটুর ঝাঁকুনি।
2. জটিল প্রতিবর্ত : যেসকল প্রতিবর্ত সুষুম্নাকাণ্ড এবং মস্তিষ্কের সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং যার প্রতিবর্ত চাপ বহুসংখ্যক নিউরোন দ্বারা গঠিত, তাকে জটিল প্রতিবর্ত বলে। যেমন—সাইকল চালানো।
একটি প্রতিবর্ত ক্রিয়ার বর্ণনা :
ঝোলানো পায়ের হাঁটুর মালাইচাকির নীচে কণ্ডরায় হাতুড়ি দ্বারা মৃদু আঘাত করলে পা ঝাঁকুনি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। একে ‘হাঁটু ঝাঁকুনি' বা 'জানুক্ষেপ প্রতিবর্ত' বলে।
- (1) প্রথমে কণ্ডরায় অবস্থিত গ্রাহক আঘাতের উদ্দীপনা গ্রহণ করে।
- (2) এরপর অন্তর্বাহী নিউরোন ওই উদ্দীপনাকে সুষুম্নাকাণ্ডের ধূসর বস্তুতে প্রেরণ করে।
- (3) সুমুয়াকাণ্ডের ধূসরবস্তু চেষ্টীয় উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।
- (4) এরপর বহির্বাহী নিউরোন ওই চেষ্টীয় উদ্দীপনাকে পায়ের পেশিতে প্রেরণ করে।
- (5) ফলে পায়ের পেশি সংকুচিত হয় এবং পা ঝাঁকুনি দিয়ে এগিয়ে যায়।
সহজাত প্রতিবর্ত ও অভ্যাসগত প্রতিবর্তের মধ্যে পার্থক্য
নং | সহজাত প্রতিবর্ত | অভ্যাসগত প্রতিবর্ত |
---|---|---|
১ | এটি জন্মগত, শর্তনিরপেক্ষ, পূর্ব অভিজ্ঞতা বিহীন ও চিরস্থায়ী। | এটি জন্মের পর সৃষ্ট, শর্তসাপেক্ষ, পূর্ব অভিজ্ঞতাযুক্ত ও পরিবর্তনীয়। |
২ | এটির প্রতিবর্ত পথ সরল এবং কেবল সুষুম্নাকাণ্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। | এটির প্রতিবর্ত পথ জটিল এবং সুষুম্নাকাণ্ড ও মস্তিষ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত : |