বাষ্পমোচন
বাষ্পমোচন (Transpiration)
সংজ্ঞা (Definition):
যে প্রক্রিয়ায় দিনের বেলায় সূর্যালোকের উপস্থিতিতে উদ্ভিদের অতিরিক্ত জল উদ্ভিদের বায়বীয় অংশের মাধ্যমে (প্রধানত পত্ররন্ধ্র দিয়ে) বাষ্পাকারে নির্গত হয় তাকে বাষ্পমোচন বা প্রস্বেদন বলে।
প্রকারভেদ (Types):
বাষ্পমোচন প্রধানত তিনপ্রকার-
- (i) পত্ররন্ধ্রীয় (Stomatal) বাষ্পমোচন-স্টোমাটা বা পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে যে বাষ্পমোচন ঘটে।
- (ii) লেন্টিসেলীয় (Lenticular) বাষ্পমোচন-লেন্টিসেল বা কান্ডরন্ধ্রের মাধ্যমে যে বাষ্পমোচন হয়;
- (iii) কৃত্তিকীয় (Cuticular) বাষ্পমোচন- কান্ড ও পাতার ত্বকের উপর কিউটিকল্-এর আবরণের ফাটলের দ্বারা যে বাষ্পমোচন হয়। পত্ররন্ধ্রীয় বাষ্পমোচন দু-প্রকারের হয়, যথা-
- (a) ফটোঅ্যাকটিভ-অধিকাংশ উদ্ভিদে দিনের বেলায় পত্ররন্ধ্র খুলে যে বাষ্পমোচন হয়;
- (b) স্কোটোঅ্যাকটিভ-পাথরকুচি প্রভৃতি উদ্ভিদে রাত্রিবেলায় পত্ররন্ধ্র খুলে যে বাষ্পমোচন হয়।
বাষ্পমোচনের প্রভাবকসমূহ (Factors affecting transpiration):
বহিঃপ্রভাবকঃ
- 1. আলো (light) আলোর উপস্থিতিতে ঘতে, ফলে আলো কম হলে বাষ্পমোচন কম হয়।
- 2. তাপমাত্রা (Temperature)-তাপমাত্রা যত বেশি হয় বাষ্পমোচন তত বেশি হয়।
- 3. বায়ুর বেগ, আর্দ্রতা ও চাপ (Velocity, Humidity and Pressure of Air)-বায়ুর বেগ বাড়লে বাষ্পমোচন ভালো হয়। বায়ুর আর্দ্রতা ও চাপ বাড়লে বাষ্পমোচন কম হয়।
- 4. জল (Water)- উদ্ভিদ প্রয়োজনমতো জল পরিবেশ থেকে গ্রহণ করতে পারলে বাষ্পমোচন ভালো হয়।
- 5. কার্বন ডাইঅক্সাইড (Carbon dioxide)-বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ কম হলে বাষ্পমোচন ভালো হয়।
অন্তঃপ্রভাবকঃ
- 1. পত্ররন্ধ্রের সংখ্যা ও অবস্থান (number and position of stomata)- পত্ররন্ধ্রের সংখ্যা যত বেশি থাকে বাষ্পমোচন তত ভালো হয়। পত্ররন্ধ্র যদি ত্বকের গভীরে থাকে (গভীর পত্ররন্ধ্র) বাষ্পমোচন কম হয়।
- 2. পত্রফলকের গঠন (Structure of Lamina)- পত্রফলক যত প্রসারিত হয় বাষ্পমোচন তত ভালো হয়।
- 3. রোম বা মোমের উপস্থিতি (Presence of trichomes or waxes): পত্রফলকের ওপর রোম বা শল্ক বা মোমের আবরণ থাকলে বাষ্পমোচন কম হয়।
- 4. হরমোন (Hormones)- অ্যাবসিসিক অ্যাসিড পত্ররন্ধ্র বন্ধ করে বাষ্পমোচন রোধ করে।
- 5. মেসোফিল কলা (Mesophyll tissue)- মেসোফিল কলার কোশ যতবেশি কোশান্তর রন্ধ্রযুক্ত হয় তত বাষ্পমোচন ভালো হয়।
বাষ্পমোচনের গুরুত্ব (Importance of transpiration):
- 1. রসের উৎস্রোতঃ বাষ্পমোচনের ফলে যে ঊর্ধ্বমুখী টানের সৃষ্টি হয় তার দ্বারা রসের উৎস্রোত ঘটে।
- 2. জলশোষণঃ বাষ্পমোচন টানের ফলে নিষ্ক্রিয় জলশোষণ ঘটে।
- 3. লবণশোষণঃ বাষ্পমোচনের ফলে উদ্ভিদ অতিরিক্ত জল শোষণ করে ফলে প্রয়োজনমতো লবণশোষণ সম্ভব হয়।
- 4. তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণঃ এই প্রক্রিয়ায় জল পাতা থেকে লীনতাপ নিয়ে বাষ্পীভূত হয় বলে পাতা শীতল হয়।
- 5. জলের ভারসাম্যঃ উদ্ভিদের অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যায় বলে কোশের নির্দিষ্ট রসস্ফীতি বজায় থাকে।
- 6. জল সরবরাহঃ বাষ্পমোচনের ফলে জলশোষণ ভালো হয় বলে উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে জল সরবরাহ ভালো হয়।
- 7. খাদ্য পরিবহনঃ বাষ্পমোচন সঠিক জল সরবরাহের মাধ্যমে খাদ্য পরিবহনে সহায়তা করে।
- 8. বৃদ্ধির সহায়কঃ বাষ্পমোচন পরোক্ষভাবে বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
বাষ্পমোচনের উপরিউক্ত বহু উপকারী ভূমিকা থাকলেও এর কিছু ক্ষতিকর দিক আছে যেমন-
- (i) বাষ্পমোচনের জন্য শক্তি (ATP) ব্যয়িত হয় এবং
- (ii) জলের ঘাটতি থাকলেও বাষ্পমোচন হয়ে উদ্ভিদের অবনমন (wilting) ঘটে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বিজ্ঞানী কার্টিস (Curtis) তাই বলেছেন “বাষ্পমোচন একটি প্রয়োজনীয় শক্তি” (necessary Evil)।
বাষ্পমোচন ও বাষ্পীভবনের পার্থক্যঃ-
নং | বাষ্পমোচন | বাষ্পীভবন |
---|---|---|
১ | রক্ষীকোশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া | জীবের নিয়ন্ত্রণবিহীন ভৌত প্রক্রিয়া |
২ | দিনের বেলায় উদ্ভিদের বায়বীয় অংশে ঘটে। | দিবারাত্র তরলের উপরিতল থেকে ঘটে। |
৩ | শোষণ চাপ, অভিস্রবণ চাপ, ব্যাপন চাপ প্রভৃতির উপর নির্ভর করে। | এসকল চাপের কোনো অস্তিত্ব নেই। |
৪ | উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া | উদ্ভিদে প্রয়োজনীয় নয়। |
উদ্ভিদের বাষ্পমোচনের হার নির্ণয়ের পরীক্ষা (Experiment to demonstrate the rate of transpiration in plants):
উপকরণ (Requirements): মূলসহ একটি কচুগাছ, কনিক্যাল ফ্লাক্স, তেল জল, কার্পাস তুলো, ব্লেড, কম্প্রেশন তুলাযন্ত্র।
পরীক্ষা পদ্ধতি (Procedure):
কনিক্যাল ফ্ল্যাস্কটির প্রায় গলা পর্যন্ত জলপূর্ণ করা হল। জলের ভিতরে ব্লেড দ্বারা কচুর একটি বৃন্তকে কেটে দ্রুত ফ্লাস্কের জলে ডুবিয়ে পাতা দেওয়া হল। এবার কয়েক ফোঁটা তেল জলের উপর দিয়ে কার্পাস তুলোর সাহায্যে কচুর বৃন্তটি ফ্লাস্কের মুখে এমনভাবে আটকানো হল যাতে কর্তিত বৃন্তটি ফ্লাস্কের তলদেশ স্পর্শ করে। এবার সমগ্র পরীক্ষা ব্যবস্থাটি ওজন করে (W1 gm) সূর্যালোকে রাখা হল। কয়েক ঘণ্টা পর পরীক্ষা ব্যবস্থাটির পুনরায় ওজন (W2 gm) নেওয়া হল।
আকাঙ্খিত ফল (Expected Results): দেখা যাবে প্রথমবার ওজনের (W1 gm) তুলনায় দ্বিতীয় বারের ওজন (W2 gm) কম।
সিদ্ধান্ত (Inference): পাতাটির ফলক থেকে জল বাষ্পমোচন প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় বারের ওজন প্রথম বারের তুলনায় কম হয়েছে।
বাষ্পমোচনের হার (Rate of transpiration):
বাষ্পমোচনের ফলে নির্গত জলের পরিমাণ ‘ W1 gm-W2 gm’। এই পরিমাণ জল যদি ‘t’ মিনিট সময়ে নির্গত হয় তাহলে বাষ্পমোচনের হার = (W1-W2)gmt মিনিট=W1-W2t ml/মিনিট।
কয়েকটি বাষ্পমোচনের প্রতিরোধী বস্তু (Antitranspirant) হল অ্যাবসিসিক অ্যাসিড, অ্যাসপিরিন, CO2, ফিনাইল মারকিউরিক অ্যাসিটেট। বাষ্পমোচন কমিয়ে চারাগাছের মূলকে মাটির সাথে উপযুক্ত সংযোগ ঘটিয়ে সতেজ রাখার জন্য চারা রোপণ বিকেলে করা হয় এবং কয়েকটি পাতা ছেঁটে ফেলা হয়।