পশ্চিমবঙ্গের ভূপ্রকৃতি
একমাত্র মরু অঞ্চল ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে সবরকমে ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও ভূমির গঠন অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গকে তিনটি প্রধান ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলে ভাগ করা যায়। যথা- (ক) উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল (খ) পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি অঞ্চল (গ) গঙ্গার বদ্বীপসমূহ সমভূমি অঞ্চল।
উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল
- অবস্থান- শিলিগুড়ি মহকুমা বাদে সম্পূর্ণ দার্জিলিং জেলা এবং জলপাইগুড়ি জেলার কিছু অংশ এই পার্বত্য অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।
- ভূ-প্রকৃতি- বন্ধুর পার্বত্যভূমি, খাড়া ঢাল, গভীর গিরিখাত এই অঞ্চলের প্রধান প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। তিস্তা নদী এই পার্বত্য অঞ্চলকে পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি ভাগে ভাগ করেছে।
- তিস্তা নদীর পশ্চিমদিকে দার্জিলিং হিমালয়ের সর্বোচ্চ অংশ অবস্থিত। এখানকার প্রধান দুটি পর্বতশ্রেণি সিঙ্গালীলা ও দার্জিলিং শৈলশিরা। সান্দাকফু (৩৬৩০ মিঃ), ফালুট (৩৫৯৫ মিঃ), সবরগ্রাম (৩৫৪৩ মিঃ), টাংলু (৩০৩৬ মিঃ) প্রভৃতি শুরু হয়ে খাড়াভাবে উত্তরের দিকে উঠে গেছে। এই পর্বত ঘুম রেঞ্জ নামে পরিচিত।
- দার্জিলিং পর্বতশ্রেণির প্রধান শৃঙ্গ হল টাইগারহিল (২৫৭৩ মিঃ) এখান থেকে ভোরবেলায় আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। টাইগারহিলের দক্ষিণে রয়েছে ডাউহিল। কার্শিয়াং মালভূমি অঞ্চল শহরটি ডাউহিলের পশ্চিমঢালে অবস্থিত। কালিম্পংএর কাছে ছোট্ট শহর পেডং।
পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল
- অবস্থান- বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমের উঁচু-নীচু ঢেউ খেলানো বিস্তৃত ভূমিভাগ পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত।
- মালভূমি অঞ্চলের ছোট ছোট পাহাড়গুলিকে স্থানীয় ভাষায় ‘ডুংরী’ বলে। পুরুলিয়া জেলার পশ্চিমাংশে কংসাবতী ও সুবর্ণরেখা নদীর মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে অযোধ্যা পাহাড় ও বাঘমুন্ডি পাহাড়। অযোধ্যা পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল গোর্গাবুরু (৬৭৭ মিঃ)।
গঙ্গার দ্বীপসমূহ ও সমভূমি অঞ্চল
অবস্থান- উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল ও পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল বাদে পশ্চিমবঙ্গের বাকি অঞ্চল সমভূমির অন্তর্গত। উত্তরে শিলিগুড়ি থেকে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের উপকূল পর্যন্ত এই সমভূমি বিস্তৃত।
ভূমিরূপের বৈচিত্র্য অনুসারে সমগ্র অঞ্চলটিকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন-
- (ক) উত্তরবঙ্গের সমভূমি অঞ্চল- শিলিগুড়ি থেকে গঙ্গা নদীর উত্তর তীর পর্যন্ত অঞ্চলকে উত্তরবঙ্গের সমভূমি বলে। এর দুটি উপবিভাগ হল-
- (i) তরাই বা ডুয়ার্স- দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমা বাদে এবং জলপাইগুড়ি জেলার অধিকাংশ এলাকা এই অঞ্চলের অন্তর্গত। ‘তরাই’ শব্দের অর্থ স্যাঁতসেঁতে নিম্নভূমি। তিস্তা নদী অঞ্চলটিকে দুইভাগে ভাগ করেছে, তিস্তার পশ্চিমপাড় তরাই এবং পূর্বের পাড় দূয়ার বা ডুয়ার্স। এটি ভুটান হিমালয়ের প্রবেশদ্বার।
- (ii) উত্তরের সমভূমি- তরাই অঞ্চলের দক্ষিণ থেকে গঙ্গা নদীর উত্তর তীর পর্যন্ত উত্তরের অঞ্চল অবস্থিত। এই অঞ্চল আবার তিনটি উপবিভাগে বিভক্ত। যথা-
- (অ) বরেন্দ্রভূমি- উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার দক্ষিণ ভাগে এবং মালদহ জেলার পূর্বভাগের যে অঞ্চলটি প্রাচীন পলিমাটি দ্বারা গঠিত হয়েছে তার নাম বারিন্দ বা বরেন্দ্রভূমি।
- (আ) দিয়ারা- মালদহ জেলার পশ্চিম দিক দিয়ে কালিন্দি নদী বয়ে গেছে। কালিন্দীর দক্ষিণ ভাগের নবীন পলিগঠিত ভূভাগ দিয়ারা নামে পরিচিত।
- (ই) তাল- তাল কথাটির অর্থ হ্রদ বা জলাভূমি। মালদহ জেলার কালিন্দী ও মহানন্দা নদীর মধ্যবর্তী এলাকা, কোচবিহার, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা এবং শিলিগুড়ির দক্ষিণ ভাগের কোথাও কোথাও নিম্নভূমি আছে। এই অঞ্চলগুলিতে প্রায়ই বন্যা হয়। বন্যার জলের জন্য এই নিম্নভূমিটি তাল নামে পরিচিত।
- (খ) দক্ষিণবঙ্গের সমভূমি
- (i) রাঢ় অঞ্চল- পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল এবং ভাগীরথী নদীর মধ্যবর্তী যে সমভূমিটি আছে তাকে রাঢ় অঞ্চল বলে। লাল মাটি দিয়ে গঠিত হলে এই অঞ্চল ‘রাঢ়’ নামে পরিচিত।
- (ii) গাঙ্গেয় বদ্বীপ সমভূমি-
- (অ) মৃত প্রায় ব-দ্বীপ- মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলার সমভূমি মৃতপ্রায় ব-দ্বীপ নামে পরিচিত। কারণ, পূর্বে এই অঞ্চলের নদীগুলি ব-দ্বীপ গঠনের কাজে সক্রিয় ছিল। কিন্তু বর্তমানে ভাগীরথি নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ার ফলে অধিকাংশ নদী মজে গেছে। এই অঞ্চলকে ‘বাগড়ী’ অঞ্চল বলে।
- (আ) পরিণত ব-দ্বীপ- বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া ও হুগলী জেলার সমভূমি পরিণত ব-দ্বীপ সমভূমি নামে পরিচিত। এই জেলাগুলিতে ব-দ্বীপ গঠনের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে।
- (ই) সক্রিয় ব-দ্বীপঃ দঃ ২৪ পরগণা জেলার দক্ষিণ পূর্বাংশে, উত্তর ২৪ পরগণা জেলার দক্ষিণাংশে প্রচুর পরিমাণে পলি সঞ্চয় করে ব-দ্বীপ গঠনের কাজ চলছে বলে এই অঞ্চলকে সক্রিয় ব-দ্বীপ বলে। সম্প্রতি সুন্দ্রবনে ‘দক্ষিণে পূর্বাশা’ বা ‘নিউমুর দ্বীপ’ ইচ্ছামতী এ রায় মঙ্গল নদী যেখানে বঙ্গোপসাগরের মোহনা সৃষ্টি করেছে সেখানে জেগে উঠেছে।
- (iii) উপকূলের বালুকাময় সমভূমি- পূর্ব মেদিনীপুরের বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল উপকূলের বালুকাময় সমভূমি বা বালিয়াড়ি নামে পরিচিত। এখানে বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি দেখা যায়। কাঁথি ও দীঘার বালিয়াড়ি এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
- (iv) সুন্দরবনঃ উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার দক্ষিণাংশ-এ সুন্দরবন অবস্থিত। পলিগঠিত নীচু সমতল ভূমি, কর্দমাক্ত ও লবণাক্ত জলাভূমি, জলের মতো ছড়ানো অসংখ্য শাখানদী, দ্বীপ, চর, খাড়ি ইত্যাদি এই অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য।