উপসর্গ ও অনুসর্গ - জেনে রাখা ভালো
অনুসর্গ ও উপসর্গের মধ্যে পার্থক্য
নং |
অনুসর্গ |
উপসর্গ |
১ |
প্রকৃতপক্ষে অর্থময়। কিন্তু অনুসর্গ হিসাবে ব্যবহারের সময় নিজস্ব ত্যাগ করে ভিন্ন ব্যঞ্জন গ্রহন করে। |
প্রকৃতপক্ষে অর্থহীন। কিন্তু যার সঙ্গে যুক্ত হয় তার অর্থের পরিবর্তন ঘটায়। |
২ |
শব্দের পরে বসে অর্থাৎ বিশেষ্য ও সর্বনামের সঙ্গেই যুক্ত হতে পারে। |
সগব্দের বা ধাতুর পূর্বে যুক্ত হয়। বিশেষ্য, সর্বনাম ছাড়াও ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। |
৩ |
অনুসর্গটি শব্দের পাশে বসলেও পৃথক থাকে। |
শব্দের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। |
৪ |
কারকত্ব বিধান করে। |
নতুন শব্দ ও অর্থ সৃষ্টি করে। |
৫ |
প্রায় প্রত্যেক অনুসর্গেরই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ব্যবহার আছে। |
দু-একটি ছাড়া অধিকাংশ উপসর্গের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ব্যবহার নেই। |
বিভক্তি ও অনুসর্গের পার্থক্য
নং |
বিভক্তি |
অনুসর্গ |
১ |
সম্পূর্ণ অর্থহীন ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি। |
স্বতন্ত্র অর্থ থাকলেও সাধারণত সে অর্থ ত্যাগ করে অনুসর্গ রূপে প্রযুক্ত হয়। |
২ |
কারকত্ব বিধান করে। |
কারকত্ব বিধান করে। |
৩ |
শব্দের শেষে শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়। |
শব্দের শেষে বসে বটে তবে সর্বদা শব্দের সঙ্গে যুক্ত করে লেখা হয় না। |
৪ |
শব্দের সঙ্গে যুক্ত হতে অন্য কার সাহায্য লাগে না। |
শব্দের সঙ্গে যুক্ত হতে কখনো কখনো বিভক্তি চিহ্নের প্রয়োজন হয়। |
৫ |
কখনও স্বাধীন ব্যবহার নেই। |
প্রায় প্রত্যেক অনুসর্গের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ব্যবহার আছে। |
এই আলোচনা থেকে বোঝা যায় অনুসর্গ সম্পর্কে আমাদের আলোচনা দু-দিক থেকে হাওয়া দরকার। (ক) কী কী জাতীয় শব্দ অনুসর্গ হয়?
(খ) অনুসর্গ ও কারকের সম্পর্ক।
(ক) কী কী জাতীয় শব্দ অনুসর্গ হয় :
বাংলায় আমরা দু-জাতের শব্দকে অনুসর্গ হিসাবে ব্যবহৃত হতে দেখি। প্রথম দল অব্যয়, দ্বিতীয় দল অসমাপিকা ক্রিয়া।
অব্যয় : দ্বারা, দিয়া, কর্তৃক, জন্য, তবে, হেতু, কারণ, বিনা, কাছে, মধ্যে, নিকটে, ইতি, ব্যতীত। অসমাপিকা ক্রিয়া : হতে (হইতে), থেকে (থাকিয়া), চেয়ে (চাহিয়া), লাগি (লাগিয়া), বলে (বলিয়া), করে (করিয়া)।
(খ) অনুসর্গ ও কারকে সম্পর্ক :
আমরা জানি, অনুসর্গ কারকত্ব বিধান করে। নীচে বিভিন্ন কারকে নানা অনুসর্গের ব্যবহার দেখান হল-
কর্তৃ কারক : কর্তৃ কারকে সাধারণত অনুসর্গের ব্যবহার হয় না। তবে কর্মবাচ্যের কর্তায় অনুসর্গের প্রয়োগ হয়। প্রসঙ্গত বলা যায়, কর্মবাচ্যের কর্তাকে অনুক্ত কর্তা বলে। অনুক্ত কর্তায় দ্বারা, দিয়ে, হতে, কর্তৃক ইত্যাদি অনুসর্গ প্রযুক্ত হয়। যেমন-
আমা হতে এ কার্জ হবে না সাধন। রাম কর্তৃক রাবণ নিহত হন।
কর্ম কারকে অনুসর্গের ব্যবহার হয় না।
করণ কারক : করণ কারক সাধারণত অনুসর্গ দিয়েই গঠিত হয়। দ্বারা, দিয়া (দিয়ে), কর্তৃক অনুসর্গের ব্যবহার বেশি। এ ছাড়াও অন্য অনুসর্গ ব্যবহার হয় :
মন্ত্র দ্বারা ভূত তাড়ানো যায়, রোগ সরানো যায় না। তোমাকে পুলিশ দিয়ে শায়েস্তা করব। গোটা মাঠ কাস্তে দিয়ে সাফ করে গেছে। এ সন্তান হতে বংশদ্ধার হবে না। তারা জোর করে ধান কেটেছে।
নিমত্ত কারক : জন্যে, তরে, হেতু, কারণ, লেগে (লাগিয়া) ইত্যাদি অনুসর্গ দিয়ে নিমিত্ত কারক তৈরি হয়। যেমন- সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু।
পুত্রের জন্য এ বইখানি কিনলাম। সকলে আমরা পরের তরে।
অপাদান কারক : হতে (হইতে), থেকে (থাকিয়া), চেয়ে (চাহিয়া) ইত্যাদি অনুসর্গ অপাদান কারকে ব্যবহৃত হয়। যেমন-
গাছ হইতে নামিয়া আইস। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। মার কাছ থেকে টাকাটা চেয়ে নিতে হবে।
অধিকরণ কারক : মধ্যে, কাছে, নিকট ইত্যাদি অব্যয় অধিকরণ কারকে অনুসর্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
তারা ছাদ থেকে মিছিল দেখছে। মনের ভিতর প্রতিজ্ঞা জাগাও। কবিদের মধ্যে কালিদাস শ্রেষ্ট।
রাস্তা দিয়ে কারা যাচ্ছে? দেবতার দান মাথায় করে রেখো। পিতার নিকট লোক পাঠাও।
অনুসর্গের ব্যবহারের রীতি : অনুসর্গের ব্যবহারকে ছ-টি দিক থেকে বিচার করা যেতে পারে।
(ক) অনুসর্গের সাধারণ ব্যবহার :
অনুসর্গ সাধারণত শব্দের শেষে অন্য কিছুর সাহায্য ছাড়া ব্যবহৃত হয়। যেমন-
চোখ দিয়ে জল পড়ছে। কালদাস কর্তৃক শকুন্তলা নাটক বিরচিত হয়।
(খ) কখনও বিভক্ত চিহ্ন দ্বারা অনুসর্গ যুক্ত হয়:
সকলে আমরা পরের তরে। তিন অধ্যয়নের নিমিত্ত কাশী যাত্রা করলেন। পাতের থেকে বেড়ালে মাছ নিয়ে গেল।
(গ) একই অনুসর্গ একাধিক কারকেও ব্যবহৃত হয় :
দ্বারা : তার দ্বারা বক্তৃতা দেওয়া চলবে না (কর্তৃ)। চৈতন্য দ্বারা দেখাই প্রকৃত দেখা (করণ)।
দিয়ে (দিয়া) : এ দা দিয়ে চোরের নাকও কাটে না (করণ)। চোখ দিয়ে জল পড়ছে (অপাদান)। রাস্তা দিয়ে মিছিল যাচ্ছে (অধিকরণ)।
করে (করিয়া) : ভেলায় করে ভেসে চলল বেহুলা (করণ)। মায়ের আশীর্বাদ মাথায় করে রাখব (অধিকরণ)।
হতে (হইতে) : এ পুত্র হতে সুখের আশা নেই (করণ কারক)। আকাশ হতে স্বর্গকিরণ ঝরে (অধিকরণ)
(ঘ) নানা ক্ষেত্রে আরও বহু অব্যয় ও অসমাপিকা ক্রিয়া বাংলা ভাষায় অনুসর্গরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন-
অব্যয় : দশরথ নামে এক রাজা ছিলেন। ইতি আপনার অধম সেবক। এ বিপদে হরি ছাড়া সহায় কে? অর্থ ব্যতীত সুখ নাই। দুঃখ বিনা সুখলাভ হয় কি মহীতে? দরিদ্রের প্রতি দয়া করো। সন্ধ্যার পর সে এখানে আসিল। ব্ররক্ষের সমীপে একটি কুটির আছে। তোমার সাথে আমি যাব না। দুর্জনের সহিত সম্পর্ক রাখিয়ো না। স্বর্ণ অপেক্ষা রৌপ্যের মূলু বেশি। আমার পক্ষে তোমার আবদার রক্ষা অসম্ভব। পর্বতের উপরে আমার বাস। আলোর নীচেই অন্ধকার। তার মুখের পানে চেয়ে আমার দিন কাটে।
অসমাপিকা ক্রিয়া :
তোমার ভাই বলেই কিছু বললাম না। সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু। শীতল বলিয়া ও চাঁদ সেবিনু।
(ঙ) অনুসর্গ ব্যবহার করে নানা অর্থ সৃষ্টি করা যায় :
১. হেতু বা নিমিত্ত অর্থে : কারণ, তরে, জন্য, নিমিত্ত, লাগিয়া, বলিয়া, ইত্যাদি অনুসর্গ এই অর্থ সৃষ্টি করে। যেমন- পাতকী বলিয়া কিগো ঠেলিবে চরণে? দেশের জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকার করা সকলের কর্তব্য। কীসের তরে অশ্রু ঝরে, কীসের তরে শোক। সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু…। বধূমাতাকে সাতদিনের নিমিত্ত পাঠাইলাম।
২. তুলনা বোঝাতে : এজন্য সাধারণত চেয়ে, অপেক্ষা, হতে (হইতে), থেকে (থাকিয়া) ইত্যাদি অনুসর্গ ব্যবহার করা হয়। যেমন- ধনের চেয়ে মান বড়ো। স্বদেশবোধক স্বদেশপ্রেম হইতে পৃথক করা যায় না। দেবতা অপেক্ষা মানুষকেই বিশ্বাস করো। কোন্ দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল।
৩. ব্যতীত অর্থে : এই অর্থে ছাড়া বৈ (বই), বিহনে, নহিলে, নাহলে ইত্যাদি অনুসর্গের ব্যবহার হয়। যেমন- দুঃখ বিনা সুখলাভ লাভ হয় কি মহীতে? উদ্যম বিহনে কার পুরো মনোরথ? কানু ছাড়া গীত নাই। আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে।
৪. সীমা বা ব্যাপ্তি বোঝাতে : থেকে (থাকিয়া), পর্যন্ত, অবধি ইত্যাদি অনুসর্গ ব্যবহৃত হয়। যেমন- আশ্বিন মাস পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হল। ধৃতরাষ্ট্র জন্ম থেকেই অন্ধ। জনম অবধি হাম রূপ নেহারলুঁ।
৫. দূরত্ব বোঝাতে : দিগ্বাচক শব্দের সঙ্গে হইতে (হতে), থেকে (থাকিয়া) ইত্যাদি অনুসর্গ ব্যবহৃত হয়। যেমন-পঞ্চগ্রাম থেকে মহানন্দপুর পঞ্চাস মাইল পশ্চিমে। কলকাতা থেকে পলাশী কতদূর?
(চ) অন্য রূপে অনুসর্গের ব্যবহার :
১. ক্রিয়াবিশেষণ রূপে অনুসর্গ : এতক্ষণ ধরে বাজারে কী করছিলে?
দেশকেই সকলেই প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে।