দল বিশ্লেষণ
দল (Syllable)-এর প্রাথমিক ধারণা :
‘দল’-এর আলোচনার আগে একটু আগের কথা আলোচনা করে নেওয়া যাক-
উচ্চারণ : কথা বলতে গিয়ে মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে আপন কন্ঠ বা বাগ্যন্ত্র থেকে যে ধ্বনি বের করে সেটিই উচ্চারণ।
শব্দ : উচ্চারিত যে ধ্বনি-পরিমাণ এক একটি অর্থ প্রকাশ করে তা-ই শব্দ।
ভাষা : কোনো জনসমাজে মানিষের দ্বারা যে ভাবব্যঞ্জক কথা বা বাক্যসমষ্টি উচ্চারিত বা রচিত হয়, তা-ই ভাষা।
বাংলা ভাষা ও বাংলা বর্ণমালা :
বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, অসম প্রভৃতি স্থানে বাঙালি নামক জনসমাজে যে ভাষার উৎপত্তি হয়েছে তা-ই বাংলা ভাষা।
বাংলা ভাষায় শোনার যোগ্য ভাষাধ্বনির দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রতীক হিসেবে যে সমস্ত বর্ণ ব্যবহৃত হয়, সেই সমস্ত বর্ণের সমষ্টিকে বলে বাংলা বর্ণমালা।
স্বরধ্বনি-ব্যঞ্জনন্ধনি : যে ধ্বনি বাগ্যন্ত্র থেকে বের হবার সময় বাধা পায় না তাকে স্বরধ্বনি বলে। অ, আ, ই ইত্যাদি। যে ধ্বনি জিহ্বাদির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বাগ্যন্ত্র থেকে নিঃসৃত হয়, তাকে ব্যঞ্জনন্ধনি বলে। কয়, চ্, ৎ, ইত্যদি। স্বরধ্বনি সহযোগে ক্ + অ = ক উচ্চারিত হচ্ছে।
মৌলিক স্বরধ্বনি : অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, এ, অ্যা, ও (ঈ, ঊ বাঙালি উচ্চারণে নেই)।
যৌগিক স্বরধ্বনি : দুটি মৌলিক স্বরধ্বনির মিলনে যে যুক্তধ্বনির সৃষ্টি হয় তাকে যৌগিক স্বরধ্বনি বলে। অ + ই (ও + ই) = ঐ, অ + উ (ও উ) ঔ।
দ্রুত উচ্চারণে যে দুটি মৌলিক স্বরধ্বনি মিলে একটি যৌগিক স্বরধ্বনি হয় তাদের দ্বিতীয়টি সম্পূর্ণভাবে উচ্চারিত হয় না। দ্বিতীয় স্বরটি ভগ্নস্বর। ধাও-ধ্ + (আ + ও)। আ + ও স্বরধ্বনিটি পরিণত এবং ‘ও’ ভগ্নস্বর। এটি পূর্বস্বরের আশ্রয়ে উচ্চারিত হয় বলে ব্যঞ্জনধ্বনির শামিল। খেও= খ্ + এ + অ-এখানে এ এবং ও পৃথকভাবে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। তাই উভয়েই পূর্ণস্বর। অপূর্ণ উচ্চারিত পরনির্ভর স্বরই খন্ডস্বর। যেমন-ই্, উ্, এ্, ও্। লেখায় এ = য় : খা-এ > খায়। ব্যাকরনে এদের অর্ধস্বর (Semmi Vowel) বলে। ‘অ’ ধ্বনির বিকল্প রূপ নেই ; ব্যঞ্জনে অদৃশ্যভাবে থাকে। তাই ‘অ’-কে নিহিত স্বরধ্বনি বলে। সাধারণভাবে মনে মরা হয়, বর্ণ এবং অক্ষর একই বস্তু। কার্যত তা নয়। বর্ণ হল ধ্বনি-নির্দেশক চিহ্ন বা প্রতীক। যেমন- অ, আ, ই, ক্, চ্, ট, ত্, প্ ইত্যাদি। এক বা একাধিক বর্ণ সম্মিলিত হয়ে অর্থ বোঝালে শব্দ হয়। এখানে আমরা ‘অক্ষরে’র পরিবর্তে ‘দল’ ব্যবহার করব।
দল বা অক্ষর : বাগ্যন্ত্রের অল্পতম প্রয়াসে বা একঝোঁকে শব্দের যে হ্রস্বতম বা ক্ষুদ্র অংশ উচ্চারিত হয়, তাকে দল বা অক্ষর বলে।
হ্রস্বতম অংশ হচ্ছে অ-ব্যঞ্জন (স্বরধ্বনি ছাড়া ব্যঞ্জন ‘ক’) বা সব্যঞ্জন (ক্ + অ = ক) একটি স্বরধ্বনি। অ-ব্যাঞ্জন স্বরধ্বনি যেমন- দল, তেমনি স-ব্যঞ্জন স্বরধ্বনিও দল। একটি দলের মধ্যে একটি মৌলিক বা যৌগিক স্বরধ্বনির থাকে, একের বেশি থাকবে না। স্বরধ্বনিটির সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনি যদি থাকে, তবে তার সংখ্যা যাইহোক না কেন, দল একটিই হয়। যেমন- এ নহে কানন। এখানে ‘এ’ ব্যঞ্জনধ্বনিবিহীন একটি স্বরধ্বনি-একটি দল। হে রাম –এখানে হে (হ + এ) শব্দে একটি স্বরধ্বনির (‘এ’) সঙ্গে একটি ব্যঞ্জনধ্বনি (‘হ্’)। তাই ‘হে’ একটি দল (যদিও স্বরধ্বনির আগে ব্যঞ্জনধ্বনি আছে )। আজ আর খেলব না। এখানে ‘আজ’ (আ + জ্ -শেষ ব্যঞ্জনে হস্ চিহ্ন থাকে না কিন্তু উচ্চারণে হস্ আছে) শব্দে একটি স্বরধ্বনি ‘আ’র সঙ্গে একটি ব্যঞ্জনধ্বনি (জ্) আছে। তাই আজ দুটি বর্ণ কিন্তু আলাদা দল (এখানে স্বরধ্বনির পর ব্যঞ্জনধ্বনির অবস্থান)। ফুল দিয়ে মালা (ফ্ + উ + ল্) (শব্দে ‘হস্’ নেই উচ্চারণে হস্ আছে)। ‘উ’ একটি স্বরধ্বনির সঙ্গে দুটি ব্যঞ্জনধ্বনি ‘ফ’ ও ‘ল’ আছে। তিনটি বর্ণ থাকা সত্ত্বেও তবুও দল একটি (স্বরধ্বনিটির আগে ‘ফ’ পরে ‘ল’ আছে।) প্রেমে ভুবন করা যায়। ‘প্রেম’ (প্ + র্ + এ + ম্) শব্দে একটি স্বরধ্বনি ‘এ’ আছে। সঙ্গে তিনটি ব্যঞ্জনধ্বনি। তবুও একটি স্বরধ্বনি থাকাতে একটি দল। কবিতা বা পদ্যে দল নির্দেশ করতে গিয়ে উচ্চারণের দিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হয়। কারণ দ্রুত উচ্চারণের সময় যৌগিক স্বরের অন্তর্গত দ্বিতীয় স্বরটি ভগ্নস্বর হওয়ায় পূর্ণ উচ্চারিত হয় না অর্থাৎ এই ভগ্নস্বর পূর্ণ স্বরের মর্যাদা পায় না। যৌগিক স্বর নিয়ে একটিমাত্র দল হয়, দুটি নয়। তুমি যাও। (য্, + আ + ও) এখানে আ এবং ও পাশাপাশি দুটি স্বরধ্বনি মিলিত হয়ে যৌগিক স্বর সৃষ্টি করেছে। দ্রুত উচ্চারণের জন্য ‘আ’ পূর্ণ উচ্চারিত হলেও দ্বিতীয় স্বর ‘ও’ পূর্ণ উচ্চারিত হয় না। তাই (১) যা (২) ও দুটি স্বর থাকলেও শেষেরটি ভগ্নস্বর হওয়ায় ‘যাও’ একটি দল।