বিসর্গসন্ধি
এবার জানব বিসর্গসন্ধি সম্পর্কে। আমরা জানি বিসর্গ ধ্বনিটি ব্যাঞ্জনবর্ণমালার অন্তর্গত। একে অযোগবাহ বর্ণ বলে। সেদিক থেকে বিচার করলে বিসর্গসন্ধি ব্যঞ্জনসন্ধির একটি অংশমাত্র। বিসর্গের শ্রেণিবিভাগ : সংস্কৃত বিসর্গ ধ্বনি আসলে শব্দের শেষের র্ বা স্ ধ্বনি লুপ্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে। এদিক থেকে বিসর্গ দু-রকম-(১) র-জাত বিসর্গ (২) স-জাত বিসর্গ। যখন শব্দের শেষে ‘র’ থাকে কিন্তু উচ্চারণের সময় ‘র’ –এর বদলেঃ (বিসর্গ) উচ্চারিত হয় তখন তাকে র্-জাত বিসর্গ বলে। যেমন- অহর্ =অহঃ। অন্তর্ = অন্তঃ। বাহির্ = বহিঃ। পুনর্ = পুনঃ। অনুরূপ : নিঃ, প্রাতঃ, স্বঃ, দুঃ। আবার শব্দের শেষে ‘স’ থাকলে উচ্চারণের সময় ‘স’ –এর জায়গায় যখনঃ(বিসর্গ) উচ্চারিত হয় তখন তাকে স-জাত বিসর্গ বলে। যেমন- বয়স্ = বয়ঃ। হবিষ্ = হবিঃ মনস্ = মনঃ। আশিস্ = আশীঃ। অনিরূপ : সরঃ, শিরঃ, যশঃ, পুরঃ, তেজঃ, জ্যোতিঃ, ধনুঃ, চক্ষু। কোনো শব্দ কী-জাত বিসর্গ তা জানা থাকলে বিসর্গসন্ধির সূত্রগুলো বুঝতে সুবিধা হয়। এই অধ্যায় পড়া শেষ হলে ধারণাটা স্পষ্ট হবে। তখন বুঝতে পারবে সিন্ধির সূত্রগুলির কয়েকটি সব রকম বিসর্গের জন্য প্রযুক্তি। কতকগুলি শুধুমাত্র স্-জাত বিসর্গের, কতকগুলি শুধু র-জাত বিসর্গের। বিসর্গের সঙ্গে স্বরধ্বনি ও ব্যাঞ্জনধ্বনির মিলনে যে সন্ধি হয়, তাকে বিসর্গসন্ধি বলে। র্-জাত ও স্-জাত বিসর্গের সঙ্গে স্বরধ্বনি ও ব্যাঞ্জনধ্বনির মিলনে যে সন্ধি হয় তার ফল হয় বিভিন্ন রকম। যেমন- (১) কোথাও বিসর্গ ও স্বরধ্বনির মিলনে অ-কার হয়। (২) কোথাও বিসর্গ লুপ্ত হয়ে ব্যঞ্জনধ্বনির উদ্ভব হয়। (৩) কোথায় বিসর্গের স্থানে র্ হয়। (৪) কোথাও কোনো নতুন ধ্বনি তৈরি না হয়ে শুধুমাত্র বিসর্গই লুপ্ত হয়। (৫) কোথাও বিসর্গ বজায় থাকে। (৬) কোথাও পূর্ববর্তী হ্রস্বস্বরের দীর্ঘত্ব লাভ হয়। এবার বিসর্গ সন্ধির সূত্রগুলি উদাহরণ সহকারে আলোচনা করা হল- বিসর্গ সন্ধির সূত্র : বিসর্গ (ঃ) ও স্বরধ্বনি মিলে ‘ো’ কার হওয়া আঃ + অ = ও ো + অ ভিন্ন অন্য স্বর = বিসর্গলোপ (১) প্রথম শব্দের শেষে যদি অঃ ধ্বনি থাকে আর পরের শব্দ যদি অ দিয়ে শুরু হয় তাহলে সন্ধির ফলে ‘ঃ’ এবং ‘অ’ উভয় মিলে ‘ও’ –কার হয়। ‘ও’ –কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়। যেমন- বয় + অধিক = বয়োধিক মনঃ + অভিপ্রায় = মনোভিপ্রায় ততঃ + অধিক = ততোধিক পুরঃ + অভিমুখে = পুরোভিমুখে যশঃ + অভিলাষ = যশোভিলাষ মনঃ + অভীষ্ট = মনোভীষ্ট মনঃ + অভিলাষ = মনোভিলাষ (২) এই সূত্রেও আগের সূত্রের মতো প্রথম শব্দের শেষে যদি বিসর্গ থাকে আরও পরের শব্দ যদি অ-কার ভিন্ন অন্য কোনো স্বর হয় তবে শুধু পূর্ব বিসর্গ লোপ পায়। যেমন- অতঃ + এব = অতএব তপঃ + আধিক্য = তপআধিক্য শিরঃ + উপরি = শিরউপরি যশঃ + ইচ্ছা = যশইচ্ছা মনঃ + ইচ্ছা = মনইচ্ছা দেখা যাচ্ছে যে উপরের দুটি সুত্র মিলে আ-কারের পরস্থিত বিসর্গের সঙ্গে সবগুলি স্বরবর্ণের মিলনের রীতি বলে দিয়েছে। অর্থাৎ এ দুটি সূত্রকে এক করে নীচের ছকটি পাওয়া যাবে। অঃ + বর্গীয় ৩/৪/৫/ = অঃ স্থানে + য / র / ল /ব /হ ও ( ো ) (৩) প্রথম শব্দ যদি ‘আঃ’ দিয়ে শেষ হয় আরও পরের শব্দ যদি বর্গীয় ব্যঞ্জনের ৩য়, ৪র্থ বা ৫ম বর্ণ [অর্থাৎ গ-জ-ড-দ-ব, ঘ-ঢ-ধ-ভ, ঙ-ঞ-ণ-ন-ম] হয় বা য, র, ল, ব, হ হয় তবে ‘আঃ’ বদলে ও-কার হয়। যথা- মনঃ + যোগ = মনোযোগ সরঃ + জ = সরোজ সদ্যঃ + জাত = সদ্যোজাত বয়ঃ + বৃদ্ধি = বয়োবৃদ্ধি তপঃ + বন = তপোবন সরঃ + বর = সরোবর অহঃ + রাত্র = অহোরাত্র ছন্দঃ + বৈচিত্র্য = ছন্দোবৈচিত্র্য মনঃ + ভাব = মনোভাব যশঃ + লাভ = যশোলাভ তেজঃ + ময় = তেজোময় মনঃ + হর = মনোহর অধঃ + গতি = অধোগতি পয়ঃ + নিধি = পয়োনিধি মনঃ + রম = মনোরম পুরঃ + হিত = পুরোহিত মনঃ + রথ = মনোরথ পয়ঃ + ধি = পয়োধি বিসর্গসন্ধি ও খাঁটি বাংলা সন্ধি মনঃ + মোহন = মনোমোহন শিরঃ + ধার্য = শিরোধার্য অকুতঃ + ভয় = অকুতোভয় যতপরঃ + নাস্তি = যৎপরোনাস্তি পুরঃ + ধা = পুরোধা বক্ষঃ + দেশ = বক্ষোদেশ [মনে রাখতে হবে যে, পরে যদি ওই কুড়িটি ব্যঞ্জনবর্ণ ছাড়া অন্য কোনো ব্যঞ্জন থাকে, তবে প্রকৃতপক্ষে সন্ধি হয় না। বিসর্গ বিসর্গই থাকে। তবে কখনো কখনো একত্রে লেখা হয় মাত্র। যেমন-অতঃ + পর = অতঃপর। বয়ঃ + প্রাপ্ত = বয়ঃপ্রাপ্ত। শিরঃ + শোভা = শিরঃশোভা। মনঃ + কষ্ট = মনঃকষ্ট।] বিসর্গের ‘র’ হওয়া (৪) প্রথম শব্দের শেষে যদি অ-কারের সঙ্গে র-জাত বিসর্গ থাকে আরও পরশব্দ কোনো স্বরবর্ণ, বর্গীয় ৩য়, ৪র্থ, ৫ম বর্ণ বা য-ল-ব-হ হয়, তবে বিসর্গটি ‘র’ হয়ে যায়। কখনও রেফ্ আকারে যুক্ত হয়। যেমন- পুনঃ + আগত = পুনরাগত পুনঃ + অপি = পুনরপি প্রাতঃ + আশ = প্রাতরাশ অন্তঃ + ধান = অন্তর্ধান স্বঃ + গত = স্বর্গত অহঃ + অহঃ = অহরহঃ অন্তঃ + লঘু = অন্তর্লঘু পুনঃ + বার = পুনর্বার অহঃ + নিশি = অহনিশি অন্তঃ + ঘাত= অন্তর্ঘাত অন্তঃ + যামী = অন্তর্যামী (৫) যদি প্রথম শব্দের অ-আ ভিন্ন অন্য কোনো স্বরবর্ণের সঙ্গে বিসর্গ থাকে এবং পরের শব্দ কোনো স্বরবর্ণ বা বর্গীয় ৩য়, ৪র্থ বা ৫ম বর্ণ বা য-র-ল-ব-হ হয়, তবে বিসর্গস্থানে ‘র’ হবে। যেমন- নিঃ + অবধি = নির্অবধি > নিরবধি। বহিঃ + গমন = বহি্রগমন > বহির্গমন। [তাহলে দেখা যাচ্ছে, পরশব্দ স্বরবর্ণে শুরু হলে ওই স্বরবর্ণ র্-এর সঙ্গে মিশে যায়। নইলে ‘র’ রেফ হয়ে যায়। রেফ সর্বদা যেখানে উচ্চারিত হবে তার পরের বর্ণের মাথায় বসে।] আরও উদাহরণ দেখো : নিঃ + আকার = নিরাকার নিঃ + গত = নির্গত দুঃ + আত্মা = দুরাত্মা দুঃ + অপনেয় = দুরপনেয় নিঃ + বোধ = নির্বোধ নিঃ + ঘোষ = নির্ঘোষ নিঃ + ঝর = নির্ঝর দুঃ + যোগ = দুর্যোগ দুঃ + অবস্থা = দুরবস্থা আবিঃ + ভাব = আবির্ভাব নিঃ + জন = নির্জন আশীঃ + বাদ = আশীর্বাদ দুঃ + গতি = দুর্গতি নিঃ + অর্থক = নিরর্থক জ্যোতিঃ + ইন্দ্র = জ্যোতিরিন্দ্র নিঃ + অঙ্কুশ = নিরঙ্কুশ নিঃ + ঈক্ষণ = নিরীক্ষণ নিঃ + উৎসাহ = নিরিৎসাহ চতুঃ + বেদ = চতুর্বেদ পুনঃ + বার = পুনর্বার প্রাদুঃ+ ভাব = প্রাদুর্ভাব অন্তঃ + আত্মা = অন্তরাত্মা অন্তঃ + ইন্দ্রিয় = অন্তরিন্দ্রিয় পুনঃ + জন্ম = পুনর্জন্ম অন্তঃ + হিত = অন্তর্হিত অন্তঃ + ঈপ = অন্তরীপ অন্তঃ + অঙ্গ = অন্তরঙ্গ বহিঃ + অঙ্গ = বহিরঙ্গ বিসর্গের স্থানে শ, স, য অ + স-জাত বিসর্গ + ক খ = বিসর্গ স্থানে য্ নিঃ / আবিঃ / বহিঃ /দুঃ / চতুঃ + প ফ বিসর্গ লোপ বা য্ = (৬) পরশব্দ যদি ক,খ বা প, ফ দিয়ে শুরু হয় তাহলে পূর্ব শব্দের শেষে পরস্থিত বিসর্গ ‘স’ হয়। কিন্তু যদি ওই বিসর্হ অ-আ ভিন্ন অন্য কোনো স্বরধ্বনির পরে স-জাত বিসর্গ হয় তবে ওই বিসর্গ স্থানে ‘স’ হয়। ভ্রাতুঃ + পুত্র = ভ্রাতুষ্পুত্র নমঃ + কার = নমস্কার নিঃ + কলঙ্ক = নিষ্কলঙ্ক পুরঃ + কার = পুরস্কার নিঃ + কর্মা = নিষ্কর্মা তিরঃ + কার = তিরস্কার নিঃ + কৃতি = নিষ্কৃতি ভাঃ + কার = ভাস্কর চতুঃ + কোণ = চতুষ্কোণ বাচঃ + পতি = বাচস্পতি দুঃ + পাচ্য = দুষ্পাচ্য দুঃ + কর = দুষ্কর দুঃ + কৃতি = দুষ্কৃতি নিঃ + কন্টক = নিষ্কন্টক অনুরূপ : মনস্কামনা, তিরস্কৃত, যশস্কর, অয়স্কান্ত, তেজস্ক্রিয়। (৭) পূর্বপদ যদি নিঃ, আবিঃ, বহিঃ, দুঃ, বা চতুঃ প্রভৃতি শব্দ হয় আরও পরের শব্দ ক, খ, প বা ফ দিয়ে শুরু হয় তবে বিসর্গ স্থানে ‘য্’ হয়। যেমন- নিঃ + প্রয়োজন = নিষ্প্রয়োজন নিঃ + প্রভ = নিষ্প্রভ নিঃ + করুণ = নিষ্করুণ নিঃ + প্রয়োজন = নিষ্কাম আবিঃ + কার = আবিষ্কার চতুঃ + পদ = চতুষ্পদ দুঃ + প্রাপ্য = দুষ্প্রাপ্য বহিঃ + কৃত = বহিষ্কৃত চতুঃ + পাশ = চতুষ্পাশ ব্যতিক্রম : এই দুই নিয়মের বহু ব্যতিক্রম আছে। স্ বা ষ্ কিছুই না হয়ে বিসর্গ অবিকৃত থাকে। যেমন- স্রোতঃ + পথ = স্রোতঃপথ জ্যোতিঃ + পুঞ্জ = জ্যোতিপুঞ্জ মনঃ + কষ্ট = মনঃকষ্ট মনঃ + পীড়া = মনপীড়া অনুরূপ : মনঃকল্পিত, শিরঃকম্পন, অন্তঃকরণ, অধঃপাত, যশপ্রার্থী, পয়ঃপ্রণালী। বিসর্গসন্ধি ও খাঁটি বাংলা সন্ধি (৮-১০) পূর্ব শব্দের শেষে বিসর্গ এবং পরের শব্দের শুরুতে চ /ছ, ট/ঠ, বা ত/থ থাকে তবে বিসর্গ স্থানে যথাক্রমে শ, ষ, স হয়। ঃ + + + চ / ছ = ট / ঠ = ত / থ = বিসর্গ স্থানে শ ষ্ স্ ক. দুঃ + চরিত্র = দুশ্চরিত্র নিঃ + চয় = নিশ্চয় শিরঃ + ছেদ = শিরশ্ছেদ নিঃ + ছিদ্র = নিশ্চিদ্র খ. চতুঃ + টয় = চতুষ্টয় নিঃ + ঠুর = নিষ্ঠুর ধনুঃ + টঙ্কার = ধনুষ্টঙ্কার গ. ইতঃ + তত = ইতস্তত নিঃ + তেজ = নিস্তেজ নভঃ + তল = নভস্তল বিসর্গ লোপ বা অক্ষুণ্ণ থাকে (১১) পূর্বশব্দের শেষে বিসর্গ এবং পরের শব্দের শুরুতে ‘র্’ থাকলে, পূর্বপদের বিসর্গ লুপ্ত হয়, কিন্তু সংযুক্ত স্বরটি দীর্ঘস্বর হবে। ঃ + র = বিসর্গ লোপ + দীর্ঘস্বর যেমন- নিঃ + রোগ = নীরোগ নিঃ + রস = নীরস ধনুঃ + টঙ্কার = ধনুষ্টঙ্কার (১২) পরশব্দ শ, ষ, বা স দিয়ে শুরু হলে, পূর্ব শব্দের শেষ প্রান্তে বিসর্গ অবিকৃত থাকে। ঃ + শ্ / ষ্ / স্ = বিসর্গ লোপ হয় না। শুধু একত্রে লেখা হয়। যেমন- নঃ + শিবায় = নমঃশিবায় মনঃ + শান্তি = মনঃশান্তি (১৩) পরের শব্দ যদি স্ত, স্থ বা স্পন্দ হয় তবে পূর্ব শব্দের বিসর্গ থাকতেও পারে, লুপ্তও হতে পারে। যেমন- ঃ + স্ত / স্থ / স্প = বিসর্গ থাকবে বা লুপ্ত হবে নিঃ + স্তব্ধ = নিঃস্তব্ধ, নিস্তব্ধ অন্তঃ + স্থ = অন্তঃস্থ, অন্তস্থ অনুরূপ : দুঃস্থ, দুস্থ। মনঃস্থ, মনস্থ। নিঃস্পন্দ, নিস্পন্দ। নির্দিষ্ট নিয়ম না মেনে যেসব বিসর্গসন্ধি হয় তাকে নিপাতনে সিদ্ধ বিসর্গসন্ধি বলে। যেমন- অহঃ + নিশ = অহর্নিশ মনঃ + ঈষা = মনীষা অহঃ + অহঃ = অহরহ প্রবৃতি। বিসর্গসন্ধিতে নিপাতনে সিদ্ধ শব্দ প্রাতঃ + কাল = প্রাতঃকাল অতঃ + পর = অতঃপর অন্তঃ + করণ = অন্তঃকরণ তেজঃ + পুঞ্জ = তেজঃপুঞ্জ পয়ঃ + প্রণালী = পয়ঃপ্রণালী মনঃ + কষ্ট = মনঃকষ্ট মনঃ + কল্পিত = মনঃকল্পিত শিরঃ + পীড়া = শিরঃপীড়া দুঃ + খ = দুঃখ অহঃ + রাত্র = অহোরাত্র মনঃ + ঈর্ষা = মনীষা অধঃ + পাত = অধঃপাত মনঃ + পুত = মনঃপুত পয়ঃ + পান = পয়ঃপান তপঃ + ফল = তপঃফল