সর্বনাম
সুজয় আমার বন্ধু। সুজয়ের মামাবাড়ি থেকে ফিরছে। সুজয় বলেছে, সুজয়ের মামা একজন কবি। উপরের বাক্যগুলিতে বারেবারে সুজয়ের নাম উচ্চারণ করায় শুনতে খারাপ লাগছে। তার চেয়ে ‘সুজয়ের’ বদলে ‘সে’ এবং ‘তার’ এই দুটি পদ ব্যবহার করলে ভালো শোনাবে। যেমন- সুজয় আমার বন্ধু। সে গতকাল তার মামাবাড়ি থেকে ফিরছে। সে বলেছে, তার মামা একজন কবি। সুজয় শব্দটি বিশেষ্য। সে, তার এই দুটি বিশেষ্যের বদলে ব্যবহৃত হয়েছে এবং বিশেষ্যরই মতো কাজ করছে। এই রকম পদকে সর্বনাম বলে। যে পদ বিশেষ্যের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়ে বিশেষ্যের মতো কাজ করে, তাকে সর্বনাম বলে। নানা প্রকার সর্বনাম ১. পুরুষবাচক : উত্তম, মাধ্যম ও প্রথম পুরুষের যে-কোনো লিঙ্গের যে-কোনো নামের পরিবর্তে ব্যবহৃত সর্বনামকে পুরুষবাচক সর্বনাম বলে। যথা- আমি, আমরা, তুমি, তোমরা, সে, তারা, আপনি, আপনারা, তুই, তোরা, তোকে, এ, ও, উনি, তিনি, তাঁরা, তাঁদের, যাঁকে, কেউ ইত্যাদি। ২. নির্দেশক : যে পদ কোনো বিশেষ্যের পরিবর্তে বসে বিশেষভাবে ওই বিশেষ্যকে নির্দেশ করে, তাকে নির্দেশক সর্বনাম বলে। যথা- এটা ওগুলির চেয়ে ভালো। ‘ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।’ ওটি আমার বাড়ি। ৩. সম্মন্ধবাচক : যে এসেছে, তাঁকে ডাকো। যারা একথা বলেছে, তারা তোমার বন্ধু। প্রথম বাক্যে ‘যে’ পদটি যে ব্যক্তিকে বোঝাচ্ছে, ‘তাকে’ পদটিও তাকেই বোঝাচ্ছে। অরথাত যে দুটি পদের মধ্যে এমন সম্মন্ধ রয়েছে যে, একটি ব্যবহার করলে আরও একটি ব্যবহার করতে হবে। দ্বিতীয় বাক্যেও ‘যারা’ এবং ‘তারা’, এই দুটির মধ্যে এমন সম্মন্ধ আছে যে, একটি বসলে অপরটিকেও বসতে হবে-একটি যেন অপরটির জন্য অপেক্ষা কর আছে। এই ধরনের জোড়া সর্বনামকে সম্মন্ধবাচক সর্বনাম অথবা সাপেক্ষ সর্বনাম বলে। যেসব সর্বনাম পদ একই প্রাণী বা বস্তুকে বোঝানোর জন্যে অন্য একটি সর্বনাম পদের সঙ্গে সম্মন্ধ রেখে জোড়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেগুলিকে সম্মন্ধবাচক সর্বনাম বা সাপেক্ষ সর্বনাম বলে। ৪. অনিশ্চয়বোধক সর্বনাম : কারা যেন নীচুস্বরে কথা বলছে। কেউ সেদিন এল না। এই বাক্য দুটিতে ‘কারা’, ‘কেউ’ ইত্যাদি পদ নিশ্চিতভাবে কাউকে বোঝাচ্ছে না। তাই এ ধরনের পদকে অনিশ্চয়বোধক সর্বনাম। যেসব পদ নিশ্চিতভাবে কাউকে বা কিছুকে না বুঝিয়ে বাক্যে ব্যবহৃত হয়, সেগুলিকে অনিশ্চয়বোধক সর্বনাম বলে। এরকম আর দৃষ্টান্ত-কারও, সবাই, অনেকে, কিছু, কিছুই, অপর, সকলে, যে-কোনো ইত্যাদি। ৫. পারস্পরিক সর্বনাম : সমর ও রণেন পরস্পরকে ভালোবাসে। সীমা ও শিখা একে অন্যকে ছাড়া থাকতে পারে না। এরকম বাক্যে ‘পরস্পর’, ‘একে’, ‘অন্য’ এইসব জোড়াপদ পরস্পর সম্মন্ধ বুঝিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলিকে তাই পারস্পরিক সর্বনাম বলে। যেসব সর্বনাম পরস্পরকে সম্মন্ধ বুঝিয়ে জোড়া বেঁধে ব্যবহৃত হয়, তাদের পারস্পারিক সর্বনাম বলে। আরও দৃষ্টান্ত-আপনা-আপনি, নিজে-নিজেই, আপনি-আপনি। ৬. দৃঢ়তাসূচক সর্বনাম : তিনি নিজে একথা বলেছিলেন। এটি খোদ বড়কর্তার আদেশ। বাক্য দুটিতে ‘নিজে’, ‘খোদ’ এসব সর্বনাম দৃঢ়তা বা নিশ্চয় বুঝিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই এরকম সর্বনামকে বলে দৃঢ়তাসূচক সর্বনাম। দৃঢ়তা বোঝাবার জন্যে যেসব সর্বনাম ব্যবহৃত হয়, সেগুলিকে দৃঢ়তাসূচক সর্বনাম বলে। এই ধরনের আরও দৃষ্টান্ত-আপনিই, নিজেই, নিজেরাই। ৭. প্রশ্নবোধক সর্বনাম : একথা কে বলেছে? কী খেয়েছ? এই বাক্য দুটিতে কে, কী ইত্যাদি পদ প্রশ্ন বোঝাচ্ছে এবং কোনো প্রাণী বা বস্তু সম্মন্ধে ইঙ্গিত দিচ্ছে। এগুলিকে প্রশ্নবোধক সর্বনাম বলে। কে, কী, কারা ইত্যাদি পদ প্রশ্নবোধক বাক্যে ব্যবহৃত হলে এগুলিকে প্রশ্নবোধক সর্বনাম বলে। ৮. আত্মবাচক সর্বনাম : নিজেকে এজন্যে দায়ী করছি। আপনি এজন্যে নিজেকে দোষী ভাববেন না। এতে আঘাত পেয়েছে তারা নিজেরা। এসব ক্ষেত্রে প্রতিটি বাক্যে ‘নিজ’ পদটি বাক্যের কর্তাকেই বুঝিয়েছে। (প্রথম বাক্যে ‘আমি’, দ্বিতীয় বাক্যে ‘আপনি’, তৃতীয় বাক্যে ‘তারা’ কর্তা।) এসব বাক্যে ‘নিজ’ পদটিকে তাই আত্মবাচক সর্বনাম বলা হয়। ‘নিজ’ এই পদটি যদি বাক্যের কর্তাকে বোঝায়, তবে সেটিকে আত্মবাচক সর্বনাম বলে। ৯. যৌগিক সর্বনাম : এটা-ওটা না বেছে যেকোনো একটি কোনো। এরা-ওরা কী বলছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ কোরো না। প্রথম বাক্যে ‘এটা’ বা ‘ওটা’ দুটিই নির্দেশক সর্বনাম। দুটি সর্বনাম একসঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। দ্বিতীয় বাক্যেও ‘এরা’ এবং ‘ওরা’ এই দুটি পদের যোগের ফলে ‘এরা-ওরা’ পদটি গঠিত হয়েছে। এরকম যুক্ত সর্বনাম পদকে যৌগিক সর্বনাম বলে। ‘এরা-অরা-তারা’ পদটিও যৌগিক সর্বনাম। দুটি বা তার বেশি সর্বনাম যুক্ত হয়ে গঠিত সর্বনাম পদকে যৌগিক সর্বনাম বলে। ১০. আরও দৃষ্টান্ত-কেউ-কেউ, যে-যে, যারা-যারা, যে-সে, [যে-সে গলাগলি দেবে, তাই সহ্য করতে হবে?], তুমি-আমি ইত্যাদি। সুতরাং মোট ন-প্রকার সর্বনামের পরিচয় পাওয়া গেল- (১) পুরুষবাচক (২) নির্দেশক (৩) সম্মন্ধবাচক বা সাপেক্ষ (৪) অনিশ্চয়বোধক (৫) পারস্পরিক (৬) দৃঢ়তাসূচক (৭) প্রশ্নবোধক (৮) আত্মবাচক (৯) যৌগিক।