বাগ্ধারা
‘ভাষা সোনা-রুপার মতো জড় পদার্থ নহে যে তাহাকে ছাঁচে ঢালিব। তাহা সজীব—তাহা নিজের অনির্বচনীয় জীবনীশক্তির নিয়মে গ্রহণ ও বর্জন করিতে থাকে।'
প্রত্যেক শব্দেরই নির্দিষ্ট একটি অর্থ আছে। তবে প্রত্যেক ভাষাতেই এমন কিছু শব্দসমষ্টি আছে, যেগুলি শব্দগত আক্ষরিত অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন—‘পাকা ধানে মই’। এখানে পাকা, ধান ও মই তিনটি শব্দেরই নির্দিষ্ট এক-একটি অর্থ আছে। এখানে বাক্যাংশটির অর্থ পাকা ধানের ওপর মই দেওয়া নয়। মাঠে পাকা ধানের ওপর মই দিলে সব ধান মাঠে ঝরে যাবে। অর্থাৎ সব পাকা ধান নষ্ট হয়ে যাবে। সেদিক থেকে এই শব্দগুচ্ছের বিশিষ্ট অর্থ হল ‘সর্বনাশ করা’। ইংরেজিতে যেমন ‘dead of night’-এর অর্থ মৃত রাত্রি নয়। বিশিষ্ট অর্থ ‘নীরব নিস্তব্ধ মধ্যরাত্রি'। মানুষ মরে গেলে যেমন নিঃসাড় শবদেহ পড়ে থাকে, তেমনি মধ্যরাত্রিতে বিশ্বচরাচর সুপ্তিমগ্ন থাকে। এই জাতীয় বাক্যাংশকেই ‘বাগ্ধারা' বা Idiom বলে।
বাংলা ভাষায় এমন বাগ্ধারা অজস্র। প্রত্যেক ভাষাতেই এমন কিছু বাক্যাংশ দেখা যায় যেগুলি বহুকাল ধরে ব্যবহৃত হতে হতে একটি নির্দিষ্ট অর্থ প্রাপ্ত হয়।
এই প্রসঙ্গে বাগ্ধারার সঙ্গে প্রবাদ প্রবচনের (Proverb) পার্থক্যটি মনে রাখা জরুরি। প্রকৃতপক্ষে বাগ্ধারা বাক্যাংশ মাত্র, বাক্য নয়। বাগ্ধারার সাহায্যে আমরা নতুন বাক্য তৈরি করি ; পক্ষান্তরে প্রবাদ প্রবচন হচ্ছে তৈরি বাক্য—এখানে অনেক সময়ই আর বাক্যগঠনের প্রয়োজন হয় না।
বাংলা বাগ্ধারাগুলি দ্যোতনাধর্মী বা ব্যঞ্জনাময়। সূক্ষ্ম রসবোধে দীপ্ত এসব শব্দসমষ্টি থেকে একটা সমাজের মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। বাগ্ধারাগুলি অতীতকাল থেকে লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে ক্রমে সাহিত্যের আঙিনায় নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। সহজ ও সাবলীল ভাবপ্রকাশের জন্য বাগ্ধারা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাগ্ধারা প্রয়োগে বাক্যের অর্থ গভীরভাবে তাৎপর্যমন্ডিত হয়ে ওঠে।