কারক ও বিভক্তি ও অনুসর্গ
‘মনোহরবাবু সকালবেলায় নিজের হাতে পকেট থেকে ভিক্ষুকদের জন্য পয়সা দিলেন।’ দশটি পদ নিয়ে উপরের বাক্যটি তোইরি হয়েছে। এমনভাবে পদগুলিকে সাজানো হয়েছে যে, বাক্যটির অর্থ বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ‘সকালবেলা’ শব্দটির সঙ্গে ‘য়’ যুক্ত হয়ে ‘সকালবেলায়’ পদটি গঠিত হয়েছে; ‘নিজ’ শব্দটির সঙ্গে ‘এর’ যুক্ত হয়ে ‘নিজের’ হয়েছে; ‘হাত’ –এর সঙ্গে ‘এ’ যুক্ত হয়ে হয়েছে ‘হাতে’। এইভাবে নানা শব্দের সঙ্গে নানা চিহ্ন যুক্ত হয়ে অথবা যুক্ত না হয়ে, বাক্যটি বেশ সুন্দরভাবে তৈরি হয়েছে। কিন্তু এইসিব চিহ্ন কীভাবে যুক্ত হল-সে কথা বুঝতে হলে আর একটু বিচার দরকার। বাক্যটিতে ‘দিলেন’ হল ক্রিয়াপদ। লক্ষ করলে দেখা যাবে, বাক্যের অন্য পদগুলির সঙ্গে ‘দিলেন’ ক্রিয়াপদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। কয়েকটি প্রশ্ন করলেই বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাবে। কে দিলেন?- মনোহরবাবু কি দিলেন? – পয়সা কীসের দ্বারা দিলেন?- হাতে (অর্থাৎ হাত দ্বারা)। কার জন্য(নিমিত্ত) দিলেন?- ভিক্ষুকদের জন্য (নিমিত্ত) । কোথা থেকে দিলেন?- পকেট থেকে। কখন দিলেন?- সকালবেলায়। ? পদগুলির সঙ্গে ‘দিলেন’ ক্রিয়ার সম্বন্ধ বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ক্রিয়ার সঙ্গে এই পদগুলির বিভিন্ন সম্বন্ধকে বলে কারক। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই পদগুলি সবই বিশেষ্য। বিশেষ্যের পরিবর্তে অবশ্য সর্বনামও বসতে পারে। এর পরের বাক্যেই হয়ত ‘মনোহরবাবু’ না বলে ‘তিনি’ বলা হবে। তাই শুধু বিশেষ্য বা সর্বনাম পদই কারক হতে পারে। বাক্যে ক্রিয়াপদের সঙ্গে বিশেষ্য বা সর্বনাম পদের যে যোগ থাকে তদের কারক বলে। এই যোগ বা সম্পর্ক কেমন, তারই উপর নির্ভর করবে- কোন্ পদের সসজ্ঞে কীরকম চিহ্ন যুক্ত হবে। (ক) মনোহরবাবু দিলেন। ‘দেওয়া’ কাজটা করছেন মনোহরবাবু। যে করে সে কর্তা। সুতরাং ‘মনোহরবাবু’ এখানে কর্তৃ কারক। (খ) কী দিলেন ? –পয়সা। ক্রিয়ার আগে ‘কী’ বা ‘কাকে’ জিজ্ঞাসা করে যে উত্তর পাওয়া যায়, তা কর্ম কারক। সুতরাং ‘পয়সা’ এখানে কর্ম কারক। (গ) কীসের দ্বারা দিলেন ? –হাতে অর্থাৎ হাত দ্বারা। যার দ্বারা কাজ করা হয়, সেটি কারণ কারক। সুতরাং ‘হাত’ এখানে করণ কারক। (ঘ) কার জন্য বা নিমিত্ত পয়সা ? –‘ভিক্ষুকদের জন্য’। যে জন্য বা যার জন্য কোনো বস্তু নির্দিষ্ট হয়, সে বা সেটি নিমিত্ত কারক। সুতরাং ‘ভিক্ষুকদের’ পদটি এখানে নিমিত্ত কারক। (ঙ) কোথা থেকে দিলেন ? –পকেট থেকে। যা কিছু বিচ্ছিন হয়, তা অপাদান কারক। সুতরাং এখানে ‘পকেট’ অপাদান কারক। (চ) মনোহবাবু কখন পয়সা দিলেন ? –সকালবেলায়। যে সময়ে কাজ হয়, তা অধিকরণ কারক। [কালাধিকরণ অর্থাৎ সময়সূচক অধিকরণ] । সুতরাং ‘সকলবেলায়’ এখানে অধিকরণ কারক। (ছ) বাক্যটির অন্যান্য পদের সঙ্গে ‘দিলেন’ ক্রিয়ার সম্বন্ধ থাকলেও ‘দিলেন’ ক্রয়ার সঙ্গে ‘নিজের’ এই পদটির সোজাসুজি যোগ নেই। ‘নিজের হাতে’-অর্থাৎ হাত শব্দটির সঙ্গে এটির যোগ আছে, কিন্তু ‘দিলেন’ ক্রিয়ার সঙ্গে নেই। তাই ‘নিজের’ পদটিকে কারক বলা যাবে না। অন্য পদের সঙ্গে যে পদের সম্বন্ধ আছে, কিন্তু ক্রিয়ার সঙ্গে নেই, তাকে বলা হয় সম্বন্ধ পদ। সুতরাং ‘নিজের’ পদটি এখানে সম্বন্ধ পদ। বাংলায় বিশেষ্য বা সর্বনাম পদের সঙ্গে ক্রিয়াপদের ছয় রকমের কারক-সম্পর্ক হতে পারে; কর্তা, কর্ম, করণ, নিমিত্ত, অপাদান, অধিকরণ। এ ছাড়া বিশেষ্য বা সর্বনাম বাক্যের মধ্যে সম্বন্ধ পদ রূপ্রেও ব্যবহৃত হতে পারে। বিভক্তি যে কারকগুলির কথা আলোচনা করা হল, তার কতকগুলির সঙ্গে পৃথক বর্ণ বা চিহ্ন যুক্ত আছে, কয়েকটির সঙ্গে নেই; আবার দু-একটি কারকের পরে পৃথক শব্দে বসেছে। মনোহরবাবু- কোনো চিহ্ন বর্ণ যুক্ত নেই । পয়সা- কোনো বর্ণ যুক্ত নেই । হাতে- হাত শব্দের সঙ্গে ‘এ’ বর্ণ যুক্ত আছে। সকালবেলায়- শেষে ‘য়’ বর্ণটি যুক্ত হয়েছে । নিজের- ‘নিজের’ শব্দের সঙ্গে ‘এর’ বর্ণ দুটি যুক্ত । এসব ক্ষেত্রে, এ, য়, এর- এইসব চিহ্নের নিজস্ব কোনো অর্থ নেই। কিন্তু এগুলি শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দুটো জিনিস বোঝাচ্ছে-১) সংখ্যা এবং ২) কারক। যেমন- ‘সকালবেলায়’ এই পদ থেকে আমরা দুটো জিনিস বুঝতে পারি- ১) সকালবেলার সংখ্যা একটি; ২) এটি কোন্ সময় বোঝাচ্ছে, অর্থাৎ এটি অধিকরণ কারক। এ, য়, এর ইত্যাদি চিহ্নকে বলে বিভক্তি। সুতরাং বলা যায়, যেসব বর্ণ বা বর্ণসমসষ্টি পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার সংখ্যা এবং কারক বোঝায়, সেগুলিকে বিভক্তি বলে। ‘মনোহরবাবু’ এবং ‘পয়সা’ –এই দুটি কারকে কোনো বিভক্তি যুক্ত হয়নি। এই দুই ক্ষেত্রে তাই শূন্য বিভক্তি। অনুসর্গ প্রথম দৃষ্টান্তটিতে ‘পকেট’ পদটির পরে রয়েছে ‘থেকে’ পদ। ‘থেকে’ শব্দের একটা অর্থ আছে। এটি বিভক্তির মতো অর্থহীন নয়; কাজ করছে বিভক্তির মতোঃ- ১) সংখ্যা বুঝিয়েছে; কারণ পকেট যে একটা, তা বোঝা যাচ্ছে। তা ছাড়া ২) কারক বুঝিয়েছে; কারণ পয়স পকেট থেকে আলগা হয়ে এসেছে বুঝেই আমরা ধরতে পারছি যে, ‘পকেট’ অপাদান কারক। ‘থেকে’ পদটি হল অনুসর্গ। এরক্ম অনুসর্গ আরও আছে। যেসব পদ পৃথকভাবে কোনো পদের পরে বসে পুর্বপদটির সংখ্যা এবং কারক বোঝায়, তাদের অনুসর্গ বলে। প্রধান বিভক্তি ও অনুসর্গ প্রধান বিভক্তি : বাংলায় প্রধাণত শূন্য, এ, য়, তে, কে, র, এর এই ক-টি বিভক্তি নানা একবচন কারকের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়। বহুবচনে কিছু কিছু পার্থক্য আছে। সেকথা পরে আলোচনা করা হবে। প্রধান অনুসর্গ : বাংলায় বিভিন্ন একবচন কারকের সঙ্গে বুভিন্ন অনুসর্গ ব্যবহৃত হয়। যেমন, বিনা, ছাড়া, ব্যতীয়, ধরিয়া(ধরে), জুড়িয়া (জুড়ে), প্রতি, পানে, দিকে, দ্বারা (দিয়ে), কর্তৃক, সঙ্গে, সাথে, সহিত, সনে(পদ্যে), নিমিত্ত, জন্য(জন্যে), তরে বা লাগিয়া (পদ্যে), হইতে, থেকে, অপেক্ষা, চেয়ে, চেয়েও, পিছনে, পশ্চাতে, মাঝে (পদ্যে), মধ্যে, ভেতরে। এই অনুসর্গগুলি অব্যয়। এগুলি বিভক্তির মতো কাজ করে বলে এগুলিকে বিভক্তিস্থানীয় অব্যয় বা বিভক্তিসদৃশ অব্যয়ও বলে। এখন কারক সম্বন্ধে আরও একটি বিশদ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।