খাঁটি বাংলা সন্ধি
এ পর্যন্ত যত আলোচনা হল, সবটাই সংস্কৃত সন্ধি নিয়ে। বাংলা ভাষায় আলোচনা করতে গিয়ে সংস্কৃত সন্ধির নিয়ম শখতে হবে কেন? শিখতে হবে এই কারণে যে, বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দের খুব বেশি। চলিত ভষার সাধু ভাষায় এই ব্যবহার আরও বেশি। যেসব সংস্কৃত শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়, সেগুলির ক্ষেত্রে সন্ধিড় কী কী নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে তা জানা থাক্কলে (১) শব্দগুলির সৃষ্টি কী করে হল তা বুঝতে সুবিধা হয়- এই জ্ঞান পরে খুবই কাজে লাগে। (২) বানান ভুল অনেক কম হয়। কিন্তু সংস্কৃত ছাড়াও অন্য নানা ভহাষা থেকে বহু শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে। সংস্কৃত শব্দও অনেক সময় পরিবর্তিত হয়ে নতুন ছাড়া নিয়ে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়। যেমন- গোরু, কেষ্ট, গিন্নি, বাড়ি ইত্যাদি এইসব শব্দ ব্যবহার করতে গিয়েও অনেক সময় সন্ধি হয় পাশাপাশি দুটি শব্দ তাড়াতাড়ি ব্যবহার করতে গিয়ে ‘মেঘ’ ‘করেছে’ –এই দুটি শব্দ তাড়াতাড়ি উচ্চারণ করতে গিয়ে ‘মেগ্গরেছে’ হয়ে দাঁড়ায়। ধ্বনির এই যে পরিবর্তন, এও তো এক রকমের সন্দধি। লক্ষ করলে বুঝতে পারা যায় যে, খঁটি বাংলা শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ ধরণের অনেক নিয়ম গড়ে উঠেছে। সংস্কৃত ছাড়াও অন্য যেসব শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হয়, সেগুলির ক্ষেত্রে যে সংস্কৃত সন্ধির নিয়মে একেবারে অনুসরণ করা হয় না, তা নয়। যেমন, আইন + অনুসারে = আইনানুসারে। ‘আইন’ শব্দটি আরবি ভাষার, ‘অনুসারে’ সংস্কৃত শব্দ। এই দুটিতে মিলে দিব্যি সংস্কৃত সন্ধির নিয়ম অনুসরণ করেছে। কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় নিয়ম অনুযায়ী এ-রকম সন্ধি হয় না। অর্থাৎ এরমম সন্ধিও বাঙালি নিজস্ব। এ-রকম আরও দৃষ্টান্ত-ইরানেশ্বর, ইংলন্ডাধিপতি। কিন্তু সব বাংলা শব্দের বেলায় এ-রকম সন্ধি চলে না। বড় + আদা = বড়দা, তবু + এলো = তব্বেলো, কচু + আলু = কচ্বালু –এই রকম সন্ধি করলে নেহাতই হাস্যকর হয়ে উঠবে। কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে সন্ধি করতেই হবে, সংস্কৃতে তার ধরাবাধা নিয়ম আছে। কিন্তু বাংলায় এরকম ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করার সময়ও বাঙলিরা প্রায়ই সন্ধি করেন না। পিতৃ + আজ্ঞা = পিত্রাজ্ঞা হয়, কিন্তু আধুনিক যুগে সাধারণত কোনো বাঙালি পিত্রাজ্ঞা লেখেন না, পিতৃ-আজ্ঞা লেখেন। ‘অনুমত্যনুসারে’ না লিখে লেখেন ‘অনুমতি অনুসারে’। আসলে পাশাপাশি অবস্থিত বাংলা শব্দ উচ্চারণের সময় স্বাভাবিকভাবেই কতকগুলি ক্ষেত্রে সন্ধি হয়ে যায়। সেগুলি অনুসরণ করলেই বাংলা সন্ধির কতকগুলি নিয়ম পাওয়া যায়। এই সম্বন্ধে দুটি কথা মনে রাখা দরকার- সন্ধি করবার দিকে বাঙালির ঝোঁক কম। তবে ভাষার শক্তি এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে অনেক সময় সংস্কৃত সন্ধিবদ্ধ পদ বাক্যে ব্যবহার করা হয়। খাঁটি বাংলা শব্দের যেসব সন্ধি হয় তা বেশির ভাগ কথাবার্তার ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। চলিত ভাষায় লেখবার সময় তার মধ্যে সামান্য পরিমাণ ব্যবহৃত হয়, কিন্তু সাধু ভাষায় এগুলির ব্যবহার হয় না বললেই চলে। খাঁটি বাংলা স্বরসন্ধির নিয়ম (১) নীচের দৃষ্টান্তগুলি লক্ষ্য করো – মন + অন্তর = মনান্তর দাঁত + আলো = দাঁতালো চাষ + আবাদ = চাষাবাদ ঘর + আমি = ঘরামি এসব ক্ষেত্রে মন, চাষ, দাঁত, ঘর এইসব শব্দের শেষে ‘অ’ উচ্চারিত হয় না-হসন্ত ধ্বনি উচ্চারিত হয়। অর্থাৎ মন্, চাষ্, দাঁত, ঘর্।-এগুলির পর অ থাকলে সন্ধির ফলে অ উচ্চারিত হবার কথা। কিন্তু প্রথম দৃষ্টান্তে ‘মনান্তর’ –ও অ + আ = আ –এই নিতম অনুসরণ করেছে। এরকম আরও দৃষ্টান্ত –জেঠা + আমি = জেঠামি, ঠাকুর + আলি = ঠাকুরালি, নষ্টামি, দুষ্টামি, মিতা + আলি = মিতালি, ভাঙা + আনি = ভাঙানি ইত্যাদি। কিন্তু সব ক্ষেত্রে এরকম সন্ধি হয় না। অমল এবং অমিও, এউটি শব্দ মিলে বাংলায় ‘অমলামিয়’ হবে না। তিন দিন অন্তরকে ‘তিন দিনান্তর’ লেখা হয় না। সুতরাং বলা যায়- কিছু কিছু ক্ষেত্রে হসন্ত ধ্বনি পর অ বা আ থাকলে উভয়ে মিলে আ হয়। আ পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়। (২) শাঁখা + আরি = শাঁখারি সোনা + আলি = সোনালি পাকা + আমি = পাকামি বোমা + আরু = বোমারু এই দৃষ্টান্তগুলিতে অ + আ = আ হয়েছে ঠিক স্বরসন্ধির প্রথম নিয়মের মতোই। কিন্তু সবক্ষেত্রে এ নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। যথা- লম্বা + আরশি, তোফা + আরাম, রাঙা + আলু। এইসব বলা বা লেখার সময় সন্ধি না করে শব্দ দুটিকে পৃথকভাবেই দেখা হয়। সুতরাং বলা যায়, - কিছু কিছু ক্ষেত্রে আ এবং আ মিলে আ হয়। (৩) যশোর + ঈশ্বরি = যশোরেশ্বরী ঢাকা + ঈশ্বরি = ঢাকেশ্বরী প্রথম দৃষ্টান্তে ‘যশোর’ শব্দ ‘যশোর্’ –রূপে উচ্চারিত হওয়া সত্ত্বেও ‘‘অ বা আ + ই বা ঈ = এ’’ এই নিয়ম (স্বরসন্ধির নিয়ম) অনুসরণ করেছে। যদিও হবার কথা ‘যশোরীশ্বরী’। দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে ‘ঢাকা’ শব্দটিও সংস্কৃত নয়, তবু ওই নিয়ম অনুসরণ করেছে। কিন্তু বহুক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা যায় না। যেমন, ‘ভারতেতিহাস’ না লিখে ‘‘ভারত ইতিহাস’’ অথবা ‘ভারতের ইতিহাস’ লেখা হয়। অতএব বলা যায় – কোনো কোনো ক্ষেত্রে হসন্ত ধ্বনি বা আ-এর সঙ্গে ই বা ঈ মিলে ‘এ’ হয়। (৪) ফুল + উৎসব = ফুলোৎসব, বয়স + উচিৎ = বয়সোচিত প্রথমটি অ-কারান্ত মনে হলেও আসলে হস্ধ্বনিযুক্ত (ফুল্)। তার সঙ্গে উ যুক্ত হয়ে ‘অ বা আ + উ বা ঊ = ও’ এই নিয়ম (স্বরসন্ধির নিয়ম) অনুসরণ করেছে। দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে সংস্কৃত শব্দ ‘বয়ঃ’ বাংলায় বয়স (বয়স্) হয়েছে এবং ওই একই নিয়ম অনুসরণ করেছে। এই রকম প্রয়োগে বাঙালির অভ্যাস নেই। সুতরাং বলা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হসন্ত ধ্বনি বা উ মিলে ও হয়। (৫) পাঁচ + এক = পাঁচেক, নয় + এক = নয়েক বার + এক = বারেক, এটি সংস্কৃত নিপাতনে সিদ্ধ (অর্থাৎ অ + এ = এ)। উপরের দৃষ্টান্ত দুটিতে ‘পাঁচ্’ বা ‘নয়্’ এইভাবে। কিন্তু ‘এক’ শব্দ পরে থাক,থাকলেই ‘বারেক’-এর মতো চেহারা হবে, এই রকম ধারণা থেকেই ‘পাঁচেক’ ‘নায়েক’ এরকম শব্দ তৈরি হয়েছে। সুতরাং বলা যায়- হসন্ত অক্ষরের পরে ‘এক’ শব্দ থাকলে সে অক্ষরের হস্ধ্বনি লোপ পেয়ে এ-কার হয়। (৬) কোটি + এক = কোটিক, গোটা + এক = গোটাক প্রথম দৃষ্টান্তে ‘ই’ –কারের পর এবং দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে অ-কারের পর ‘এক’ শব্দ রয়েছে। দুই ক্ষেত্রের ‘এ’ লোপ পেয়েছে। কিন্তু দুই + এক = দুয়েক। অর্থাৎ- কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওকার ছাড়া অন্য স্বরের পর ‘এক’ শব্দ থাকলে ‘এ’ লোপ পায়। (৭) দ + এ = দয়ে, পা + এ = পায়ে শ + এ = শয়ে টু + এ = টুয়ে দা + এ = দায়ে, ঘি + এ = ঘিয়ে খ + এ = খেয়ে, ক + এ = কয়ে উপরের দৃষ্টান্তগুলিতে দেখা যাচ্ছে, এ-অক্ষর-যুক্ত শব্দের পরে এ স্থানে ‘য়ে’ উচ্চারিত হচ্ছে। একাক্ষর শব্দের পরে ‘এ’ থাকলে ‘এ’ স্থানে ‘য়ে’ উচ্চারিত হচ্ছে। অন্য কতকগুলি সন্ধির ক্ষেত্রে দেখা যায় আর-এক ব্যাপার। ছেলে + আমি = ছেলেমি মেয়ে + অলি = মেয়েলি যা + ইচ্ছে + তাই = যাচ্ছেতাই এইসব দৃষ্টান্তে দেখা যাচ্ছে, গুটিক, কোটিক ইত্যাদি সন্ধির মতো পরের পদটির প্রথম স্বরটি লোপ পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সন্ধি না করে দুটি পৃথকভাবেও লেখা হয়। যেমন, পোস্টাফিস বা পোস্ট অফিস, সিরাজুদ্দৌলা অথবা সিরাজউদ্দৌলা অথবা সিরাজ-উদ্দৌলা, কালাশৌচ বা কাল অশৌচ ইথাদি। এখানে বলে রাখা দরকার যে, বাংলা ভাষার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সন্ধি যথাসম্ভব কম করবার ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। বাংল ব্যঞ্জনসন্ধি স্বরবর্ণ অ ব্যঞ্জনবর্ণের সন্ধি ছোটো + দা = ছোট্দা মেজ + দা = মেজদা মাসি + তুতো = মাসতুতো সবগুলি দৃষ্টান্তেই সন্ধির ফলে প্রথম পদের শেষের স্বরধ্বনি লোপ পেয়েছে। প্রথম অ দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে ‘অ’ এবং ‘তৃতীয় দৃষ্টান্তে ‘ই’ ল্পপ পেয়েছে। প্রথম পদের শেষ অক্ষরটি হসন্ত ধ্বনিরূপে উচ্চারিত হয়েছে। সুতরাং বালা যায়- পরে ব্যঞ্জনবর্ণ থাকলে পূর্বপদের স্বরধ্বনি লোপ পায় এবং পূর্বপদের শেষ অক্ষরটি হসন্ত ধ্বনিরূপে উচ্চারিত হয়। অ লোপ- বড় + দাদা = বড়দা, ছোট + ঠাকুরপো = ছোট্-ঠাকুরপো কাল + সাপ = কালসাপ, কাল + নাগিনী = কালনাগিনী। মেজাদি ইত্যাদি। আ লোপ- কাঁচা + কলা = কাঁচকলা, ঘোড়া + দৌড় = ঘোড়দৌড় , জোড়া + কলম = জোড়কলম, জোড়া + মানিক = জোড়মানিক ইত্যাদি ই লোপ- পিসি + তুতো = পিসিতুতো, মিশি + কালো = মিশকালো বেশি + কম = বেশ্কম, হাড়ি + কাঠ = হাড়কাঠ, ইত্যাদি। উ লোপ– পিছু + টান = পিছুটান, উঁচু + কপালি = উঁচকপালি, এ-লোপ- পিসে + শ্বশুর = পিসশ্বশুর, (কিন্তু পিসেমশাই)। ও-লোপ- খুড়ো + শ্বশুর = খুড়শ্বশুর, মেশো + শ্বশুর = মেশোশ্বশুর (কিন্তু খুড়োমশাই, মেসোমশাই)। ব্যঞ্জনবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণে সন্ধি (১) কাঁদ্ + না = কান্না রাঁধ্ + না = রান্না আরও + না = আন্না পার্ + না = পান্না সর, + না = সন্না শির্ নি = শিন্নি এইসব দৃষ্টান্তে কাঁদ্ এবং রাঁধ্ এই দুটি ধাতুর সঙ্গে ‘না’ যোগ করে ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য তৈরি করা হয়েছে। তার ফলে দ্ এবং ধ্ স্থানে ন্ হয়েছে। অন্য দৃষ্টান্তগুলিতে র্ স্থানে ন্ হয়েছে। কাঁদ্ এবং রাঁধ্ ধাতুর সঙ্গে ‘না’ যোগ হলে এবং র-এর পর ‘না’ থাকলে দ্, ধ্, র্ স্থানে ন্ হয়। (২) সাত + জন = সাজ্জন বদ্ + জাত = বজ্জাত সৎ + চাষি = সচ্চাষি দুধ + জাল = দুজ্জাল হাত + ছানি = হাচ্ছানি রথ + চালানো = রচ্চালানো দৃষ্টান্তগুলিতে পূর্বপদের শেষ অক্ষর ত-বর্গের (ত, ত্, দ্, থ) এবং এগুলিতে স্বরধ্বনি নেই। পরপদের প্রথম অক্ষর চ-বর্গের (চ বা জ)। সন্ধির ফলে ত-বর্গের বর্ণ চ বর্গের বর্ণ হয়েছে। সুতরাং বলা যায়- ত-বর্গের স্বরধ্বনিহীন বর্ণের পর চ-বর্গের বর্ণ থাকলে ত-বর্গের বর্ণ চ-বর্গের বর্ণে পরিণত হয়। ত্ ও থ্, চ্-এ, এবং দ্ ও ধ্ জ্-এ পরিণত হয়। (৩) পর + চুলো = পচ্চুলো কার + জামাই = কাজ্জামাই জোড়া + ঝ্ড় = জোঝ্ঝড় মার + স্বাস্থ্য = মাস্স্বাস্থ্য তোর + ধার = তোধ্ধার চোর + টা = চোট্টা চোর + ডাকাত = চোড্ডাকাত জ্বর + ঠুঁটো = জ্বট্ঠুঁটো বাবার + দেনা = বাবাদ্দেনা দূর + ছাই =দুচ্ছাই গ্রামের + লোক = গ্রামেল্লোক তার + থেকে = তাত্থেকে এসব দৃষ্টান্তে র-এর সঙ্গে নানা বর্ণের সন্ধি হয়েছে। এই বর্ণগুলি হল চ-বর্গের, ট-বর্গের কিংবা ত-বর্গের তা ছাড়া রয়েছে ল, স। এগুলির সঙ্গে র্-এর সন্ধির ফলে র্ তার পরের অইসব বিভিন্ন বর্ণে পরিণত হয়েছে। প্রথম দৃষ্টান্তে র্ হয়েছে চ্, দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে হয়েছে জ্, ইত্যাদি। য, শ, ষ থাকলেও এ-রকম হত। (তবে ‘য’ বাংলায় জ-এর মতো উচ্চারিত হয়। তাই, কার + যজ্ঞ = কাজ্যজ্ঞ হবে।) সুতরাং বলা যায়- র্-এর পর চ-বর্গ, ট-বর্গ বা ত-বর্গের বর্ণ থাকলে, কিংবা য, ল, শ, ষ, স থাকলে র পরবর্তী বর্ণে পরিণত হয়। (৪) টক + গন্ধ = টগ্গন্ধ ফুট + বল = ফুড্বল মুখ + ধোওয়া = মুগ্ধোওয় হাত + ধর = হাদ্ধরা এসব দৃষ্টান্তে বর্গের প্রথম বা দ্বিতীয় বর্গের সঙ্গে বর্গের তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ণের সন্ধি হয়েছে। [ক্, ট্, ত্ এগুলি বর্গের প্রথম বর্ণ ; খ দ্বিতীয় বর্ণ ; গ এবং ব তৃতীয় বর্ণ ; ধ চতুর্থ বর্ণ]। সন্ধির ফলে প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ণ সেই বর্গের তৃতীয় বর্ণে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ- অনেক সময় বর্গের হস্যুক্ত প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ণের সঙ্গে বর্গের তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ণের সন্ধি হলে প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ণটি নিজ বর্ণের তৃতীয় বর্ণে পরিণত হয়। (৫) কাজ (জ্) + কর্ম = কাচ্কর্ম সাজ (জ্) + পোশাক = সাচ্পোশাক রাগ (গ) + করা = রাক্করা এগুলি উপরের নিয়মের বিপরীত দৃষ্টান্ত। এসব ক্ষেত্রে বর্গের তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ণের পর রয়েছে প্রথম বর্ণ। এর ফলে তৃতীয় বর্ণ প্রথম বর্ণে পরিণত হয়েছে। অনেক সময় বর্গের তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ণের পর বর্গের প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ণ থাকলে তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ণ নিজ বর্গের প্রথম বর্ণে পরিণত হয়। (৬) পাঁচ (চ্) + সের = পাঁস্সের পাঁচ (চ্) + শো = পাঁশ্শো। প্রথম দৃষ্টান্তে চ্-এর পর স থাকায় চ্ স্-য়ে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে চ্-এর পর শ থাকায় চ্ শ্-য়ে পরিণত হয়েছে। চ্-এর পর শ বা স থাকলে চ্ শ্ বা স্-য়ে পরিণত হয়। (৭) কুৎ + সিৎ = কুচ্ছিত উৎ + সব = উচ্ছব উৎ + সন্ন = উচ্ছন্ন বৎ + সর = বচ্ছর [এসব দৃষ্টান্তে ৎ + স =চ্ছ হয়েছে। কিন্তু ‘উৎসাহ’ শব্দে এ নিয়ম খাটে না।] অনেক সময় ত্-এর পর স থাকলে উভয়ে মিলে ‘চ্ছ’ হয়। সংস্কৃত সন্ধির নিয়ম লঙ্ঘনের ঝোঁক এর আগেই কিছু দৃষ্টান্তে দেখানো হয়েছে যে, বাংলায় অনেক সময় সংস্কৃত সন্ধির নিয়ম মানা হয় না। এখানে আরও কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া হচ্ছে। যথা- জগৎ + জীবন = জগজীবন (জগজ্জীবন হবার কথা) জগৎ + বন্ধু = জগবন্ধু (জগদ্বন্ধু হবার কথা) জগৎ + ময় = জগৎময় (জগন্ময় হবার কথা) বাক্য প্রোয়োগে ঃ “জগৎ জুড়ে হরির খেলা হরি জগৎময়।” ‘জগৎজয়ী’ শব্দটি সন্ধির নিয়ম অনুযায়ী ভুল হয়েও বাংলায় সুপ্রচলিত।