জলসম্পদ
জলসম্পদ (Water Resources) ঃ
যে চক্রাকার আদান-প্রদান ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাকৃতিক শক্তির সহায়তা জল, শিলামন্ডল, বারিমন্ডল ও আবহমন্ডলের মধ্যে ক্রমাগত অপ্রতিহত অবস্থায় আবর্তিত হচ্ছে তাকে ‘জলচক্র’ (Hydrological cycle) বা বারিচক্র বলে । জলচক্র হল পরিবেশের মধ্যে বিরামহীন আবর্তন ব্যবস্থা যার মাধ্যমে জল কখনো জলবিন্দুতে, কখনো বৃষ্টিরূপে, কখনো জলীয় বাষ্পরূপে, কখনো ভৌমজলরূপে আবর্তিত হয় ।
জলচক্রের তিনটি প্রধান অংশ……
- (1) বাষ্পীভবন
- (2) ঘনীভবন
- (3) বর্ষণ ও অধঃক্ষেপণ ।
জলচক্রের মাধ্যমে পরিবেশের বিভিন্ন জায়গায় যে পরিমাণ জল থাকে তা হল, সমুদ্রে 97:5 ভাগ, তুষার ও বরফের মধ্যে 1:8 ভাগ, ভৌমজলরূপে ও বভিন্ন জলাশয়ের ব্যবহার্য জল 0.5-0.7 ভাগ ।
1.1 জল ছাড়া জীব বাঁচতে পারে না ।
তাই জলের অপর নাম হল ‘জীবন’ । পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ হল জল । অথচ আমাদের পানীয় জলের পরিমাণ অতি অল্প । মোট জলের 97.5 শতাংশ হল সমুদ্রের জল । প্রায় 1.8 শতাংশ জল বরফ এবং তুষারের মধ্যে আবদ্ধ থাকে । তাই মানুষের ব্যবহার্য জলের পরিমাণ মাত্র 0.5 থেকে 0.7 শতাংশ । এই ব্যবহার্য জলের মধ্যে আবার কৃষি ও শিল্প কাজে ব্যবহৃত জলের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি । সুতরাং বিশুদ্ধ পানীয় জলের পরিমাণ খুবই অল্প । পরিবেশ দূষণের ফলে জলের সঙ্গে নানা প্রকার ক্ষতিকারক পদার্থ ও জীবাণু মিশে গিয়ে পানীয় জলের সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে ।
পৃথিবীর জলবিভাজন
জলের উৎস | মোট জলের শতকরা পরিমাণ |
---|---|
সমুদ্রের জল | 97.5 ভাগ |
তুষার ও বরফে আবদ্ধ জল | 1.8 ভাগ |
মাটির নীচের ভৌমজল ও ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন জলাশয়ের | |
ব্যবহার্য জল (ভৌম জল 0.3 ভাগ, জলীয় বাষ্প 0.001 ভাগ, জলাভূমি, নদী, ঝর্ণা—0.0002, জীবদেহ 0.005 ভাগ, হ্রদ 0.02) | 0.5-0.7 ভাগ |
1.2 জলের উৎস (Sources of Water) ঃ
পৃথিবীর সমগ্র জলরাশিকে উৎস অনুসারে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায় । ভূপৃষ্ঠের উপরিতলের জল (Surface Water) এবং B. ভৌম জল বা ভূঅভ্যন্তরের জল (Ground Water) । জলের উৎস ভূপৃষ্ঠের জল ভৌম জল বৃষ্টির জল সমুদ্রের জল স্থলভাগের অভ্যন্তরের জল নদী, ভেড়ি হ্রদ, দীঘি পুকুর, ডোবা1.3 মানবজীবনে জলের ভূমিকা :
“জলই জীবন” –একথা আমরা সবাই জানি । সমগ্র জীবজগৎ জলের উপর নির্ভিরশীল । আমাদের শরীরের 60-70 ভাগ জল ।
(1) কোষস্থ প্রোটোপ্লাজমকে সজীব ও সক্রিয় রাখতে জলের একান্ত প্রয়োজন ।
(2) খাদ্য পরিপাক ও শোষণে জল সাহায্য করে ।
(3) জল না হলে শ্বাসন হয় না । আবার জলজ জীব জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের উপর নির্ভরশীল ।
(4) রক্তের মাধ্যমে নানা বস্তু পরিবাহিক হয় । রক্তের প্রায় 90 ভাগ হল জল ।
(5) রেচন পদার্থকে জল ঘর্ম ও মূত্রাকারে শরীরের বাইরে বের করে দেয় ।
(6) শরীরে তাপ পরিবহণ, শোষণ প্রভৃতি কার্য জলের উপর নির্ভরশীল । সুতরাং জল আমাদের জীবনে একটি অপরিহার্য উপাদান ।
1.4 জলের ব্যবহার (Uses of Water) ঃ
মানুষ সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এবং জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে জলের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে । বর্তমানে নানা কাজে জল ব্যবহৃত হয় ।
(1) শহর ও নগরে বসবাসের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জলের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে গেছে ।
(2) গ্রামাঞ্চলে সমস্ত রকম কাজের জন্য জলের একান্ত প্রয়োজন । তবে বদ্ধ জলাশয়ে অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন হওয়ায় জলের চাহিদা শহরের তুলনায় কম হয় ।
(3) কৃষিকাজের জন্য জলের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি । বর্তমানে অধিক ফলনশীল শস্য উৎপাদনের প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ জলও ব্যবহার করা হচ্ছে । একই জমিতে একাধিকবার চাষ করে খাদ্য সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনে জলের ব্যবহার বাড়ছে ।
(4) জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজন মৎস্য চাষ ও জলচর প্রাণী প্রতিপালনের জন্য জলের প্রয়োজন হয় । নদীর জলের 8% কৃষিকার্যে, 2% গৃহস্থালীর কাজে, 4% শিল্পে, 12% বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবহৃত হয় ।
(5) নানা কারখানায় ও শিল্পে জলের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
1.5 ভূপৃষ্ঠের এবং ভৌমজলের অতিব্যবহার (Over utilization of Surface and Ground water) ঃ
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবীতে পানীয় জলের সমস্যা যথেষ্ট রয়েছে । এর উপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জলের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে । পৃথিবীতে মাত্র 20 শতাংশ মানুষ বিসুদ্ধ পানীয় জল পায়, 50 শতাংশ মানুষ সাধারণ জল গ্রহণ করে এবং বাকি 30 শতাংশ মানুষের পানীয় জলের অভাব রয়েছে । অন্যদিকে ব্যবহার্য জলের 70 শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিকার্যে । বিশ্বের 1/3 ভাগ মানুষ শহরে বসবাস করায় নগরায়ণের ফলে জলের চাহিদা প্রবল আকার ধারণ করেছে । 1950 সালের হিসেবে বর্তমানে জলের চাহিদা 4 গুণ বেড়েছে । বিশ্বের মোট জলের মাত্র 0.5 শতাংশ থেকে 1 শতাংশ জল ব্যবহারের উপযোগী হিসেবে পাওয়া যায় । নানা কারণে সেই সামান্য পরিমাণ জলও দূষিত হওয়ায় জলের সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে । মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য শিল্প ও কৃষির অগ্রগতি জল সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলেছে । তাই আমাদের জলের অপচয় ও দূষণ রোধ করা একান্ত কর্তব্য ।
একদিকে যেমন জলের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে অতি আহরণের কারণে ভূ-গর্ভের জলের তল নিম্নমুখী হচ্ছে । [ভারতের অনেক রাজ্যে জলতল 30 মিটারের বেশি নীচে নেমে গেছে ।]
1.6 বন্যা (Flood) ঃ
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানুষের কার্যকলাপের জন্য যখন নদী তার দুকূল ছাপিয়ে চারপাশকে জলমগ্ন করে মানুষের ক্ষতি করে, পরিবেশকে দূষিত করে তখন তাকে বন্যা বলে ।
প্রাকৃতিক কারণ :
(1) স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অতিরিক্ত এবং একটানা প্রবল বর্ষণের কারণে বন্যা হয় ।
(2) যে কোনো কারণে নদীর জলবহন ক্ষমতা কমে গেলে বন্যা হয় ।
(3) ধস, বৃক্ষচ্ছেদন প্রভৃতি নানা কারণে ভূমিক্ষয়ের ফলে নদীতে ক্রমাগত পলি জমা হওয়ার জন্য নদীর গভীরতা কমে গেলে বন্যা হয় ।
(4) পাহাড় থেকে নামার সময় নদী খাতের ঢাল খাড়াই থেকে হঠাৎ প্রায় সমতলে পৌঁছে যাওয়ায় পাহাড়ের পাদদেশে বন্যা হতে পারে ।
মানুষের তৈরি কারণ :
(1) পাহাড়ী বা উঁচু মালভূমি এলাকায় অবৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ-আবাদ, পশুচারণ, অতিরিক্ত গাছ কেটে ফেলার জন্য ভূমিক্ষয় বাড়ে । ফলে নদীতে পলি জমা হয়ে নদী গভীরতা হারায় ও অল্প বৃষ্টিতেই নদীতে বন্যা হয় । উদাহরণ-উত্তরবঙ্গের বন্যা বা আসামের বন্যা ।
(2) কৃত্রিম জলাধারে (Dam) ক্রমাগত পলি জমা হওয়ার ফলে বাঁধের জলধারণ ক্ষমতা কমে যায় । ঐ অতিরিক্ত পলি ধীরে ধীরে এমন অবস্থায় সৃষ্টি করে যখন বর্ষায় বাঁধ কর্তৃপক্ষ জল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় । ফলে বন্যা হয় । যেমন-হুগলী, হাওড়া জেলার বন্যা । দামোদরে জল ছাড়ার জন্য এই জেলাগুলিতে বন্যা দেখা দেয় ।
(3) নদীর দুপাশে জনবসতি, শিল্প, চাষের জমি গড়ে তোলার ফলে নদীর প্রসারতা হ্রাস পায় । ফলে বন্যা হয় । যেমন-বর্ধমান, মুর্শিদাবাদের বন্যা ।
(4) জলাশয় ও জলাভূমিগুলিকে বুজিয়ে ফেলার জন্য বর্ষার জলসঞ্চয়ের স্থান না পাওয়ায় বন্যা হয় । যেমন, কলকাতার পূর্বদিকের জলাভূমি ক্রমশ ভরাট হয়েছে, কন্তু জলনিকাশি খালের সংস্কার হয়নি । ফলে দক্ষিণ 24 পরগনার বন্যা ।
ভারতে কোথায় বন্যার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ?
পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং ভারতের বন্যাপীড়িত রাজ্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য । প্রতিবছর বন্যা হয় এবং কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয় । বন্যাপীড়িত মানুষের জন্য কোষাগার থেকে আরও কয়েক কোটি টাকা খরচ করতে হয় । সব মিলিয়ে বন্যা ভারতের সমাজ ও অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ।
বন্যা নিয়িন্ত্রণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ :
- (1) বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে বহুমুখী নদী পরিকল্পনা (River Valley Project) গ্রহণ করা উচিত ।
- (2) “ওয়াটার শেড ম্যানেজমেন্ট” বা জলবিভাজিকাগুলির সংরক্ষণের জন্য বনসৃজন করে ভূমিক্ষয় রোধ করা সম্ভব ।
- (3) দুর্বল পাড় রক্ষার জন্য পাঁচিল গেঁথে প্রযুক্তি প্রয়োগ করা উচিত ।
- (4) নদীর গভীরতা রক্ষার জন্য নদীর তলদেশ থেকে নিয়মিত “ড্রেজিং” (dredging) করা উচিত ।
- (5) পাহাড়ী অঞ্চলে ধস ও বন্যা নিবারণের জন্য যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করা যায় ।
- (6) বন্যাপীড়িত মানুষের আশ্রয়ের জন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবে স্থায়ী বা অস্থায়ী শিবির গড়ে তোলা উচিত ।
- (7) দৈনন্দিন আবহাওয়ার উপর আবহাওয়া দপ্তরের তরফে নিয়মিত নজরদারির বন্দোবস্ত করা এবং প্রচন্ড ঝড়, বৃষ্টি প্রভৃতি দুর্যোগের আগে জনগণকে আগেভাগে সতর্ক করার বন্দোবস্ত গৃহীত হয়েছে ।
1.7 খরা (Drought) ঃ
খরা কাকে বলে ?
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে কোনো অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হলে বা বহুদিন ধরে বৃষ্টি যদি না হয় তবে যে অস্বাভাবিক শুষ্ক অবস্থায় সৃষ্টি হয় তাকে খরা বলে । সি.জি. বেটস (1935)-এর মতানুযায়ী “কোনো অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত যদি স্বাভাবিকের 75% হয় এবং বৃষ্টির মাসগুলিতে স্বাভাবিকের 60% হয়, তবে তাকে খরা বলা হয় ।” U.S. National Weather Service খরাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন ।
যেমন-
(1) শুষ্ক পর্ব (Dry Spell) : বর্ষার সময় একনাগাড়ে পনেরো দিন ধরে মোট বৃষ্টির পরিমাণ যদি মাত্র 0.8 মিলিমিটারের কম হয়, তা হলে ঐ অবস্থাকে শুষ্ক পর্ব বা “ড্রাই স্পেল” বলে ।
(2) আংশিক খরা (Partial Drought) : বর্ষার সময়ে একটানা 29 দিন ধরে যদি গড়ে দৈনিক 0.2 মিলিমিটারের কম বৃষ্টি হয় তবে এই অবস্থাকে আংশিক খরা বলে । IMD-এর মতানুযায়ী স্বাভাবিকের 25-50% কম বৃষ্টিপাত ।
(3) পূর্ণ খরা (Absolute Drought) : বর্ষাকালে একনাগাড়ে 15 দিন যদি কোনো বৃষ্টি না হয়, তবে তাকে পরিপূর্ণ করা বলে । IMD (ইন্ডিয়ান মিটিরিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট)-এর মতে স্বাভাবিকের চেয়ে 50% কম বৃষ্টিপাত ।
খরার কারণ :
(ক) প্রাকৃতিক কারণ :
- (1) ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের স্বলপ্তা ।
- (2) স্বাভাবিক সময়ের আগে মৌসুমি বন্ধ হওয়া ।
- (3) আবহাওয়া উষ্ণ এবং শুষ্ক হয়ে ওঠার ফলে খরা সৃষ্টি হয় ।
- (4) গ্রীন হাউস প্রভাবের জন্য পৃথিবীর গড় তাপ (15°C) ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে খরা হতে পারে।
- (5) বৃষ্টিপাতের চেয়ে বাষ্পীভবনের পরিমাণ যদি বেশি হয় তাহলে খরা হয় ।
(খ) মানুষের তৈরি কারণ :
- (1) অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ কেটে ফেলার জন্য বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ হ্রাস পায় । ফলে বৃষ্টির সম্ভাবনা হ্রাস পায় । এবং খরার সম্ভাবনা দেখা দেয় ।
- (2) নগরায়ণের ফলে বাড়ি-ঘর, কল-কারখানার সংখ্যা দ্রুতি বৃদ্ধি পায় । ফলে উষ্ণতা বাড়তে থাকে । অতিরিক্ত তাপ আবহাওয়াকে উত্তপ্ত করে এবং খরা দেখা দেয় ।
ভারতের খরাপ্রবণ অঞ্চলগুলি কোথায় অবস্থিত ?
ভারতের রাজস্থান, গুজরাট, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশের দক্ষিণাংশ, ওড়িশার পশ্চিমাংশ, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ইত্যাদি সাধারণ খরাপ্রবণ অঞ্চল হিসাবে পরিচিত ।
খরা নিয়ন্ত্রণের উপায় :
সারা পৃথিবী জুড়ে যেভাবে উষ্ণতা বেড়ে চলেছে তাতে খরা নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রত্যক্ষ উপায় নেই । তবে কয়েকটি বিষয়ে আমরা সতর্কতা ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারি ।
সেগুলি হল-
- (1) নিয়ন্ত্রণ পশুচারণ;
- (2) বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ, খরা-প্রতিরোধী শস্যের উৎপাদন;
- (3) বৃক্ষরোপণ;
- (4) জলসেচের উপযুক্ত বন্দোবস্ত;
- (5) ভূমির বহন ক্ষমতা অনুসারে জমি-ব্যবহারের পরিকল্পনা ।
ভারতের যোধপুরে “সেন্ট্রাল এরিড জোন রিসার্চ ইনস্টিটিউট” (Central Arid Zone Research Institute-CAZRI) নামে একটি গবেষণা সংস্থার তত্ত্বাবধানে থর মরুভুমি সম্প্রসারণ অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ।
1.8 জলের জন্য দ্বন্দ্ব (Conflicts over water)
পরিবেশের জল ও সমস্যা :
পরিবেশের অন্যতম উপাদান হল জল । জলই জীবন । প্রতিটি জীব জলের ওপর নির্ভরশীল । কিন্তু জলসংকট ও জলদূষণ পরিবেশের এক বিরাট সমস্যা ।
(1) কৃষিকার্যে জলসেচের কারণে, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে জলসংকট অনিবার্য ।
(2) নানা প্রকার ধাতব দূষণ, কীটনাশক দূষণ, বর্জ্য দূষণ জল সমস্যাকে বৃদ্ধি করেছে ।
(3) পৃথিবীর মোট জলের মাত্র 1.6 শতাংশ ব্যবহার্য জলের মধ্যে 0.6 শতাংশ গ্রহণযোগ্য। এই অবস্থায় জলদূষণ এক বিরাট সমস্যা। তাই জলসমস্যা পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচার্য বিষয়।
(4) বিশ্বের 30 শতাংশ মানুষের পানীয় জলের অভাব রয়েছে, 50 শতাংশ মানুষ সাধারণ জল গ্রহণ করে আর মাত্র 20 শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জল পায়।
(5) ব্যবহার্য জলের 70 শতাংশ কৃষিকার্যে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান জলের জন্য দ্বন্দ্ব খুব বেশি অপ্রত্যাশিত নয়। ইতিমধ্যে আফ্রিকায় জলের জন্য ছোটো ছোটো দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
(6) উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশের তুলনায় 10-15 গুণ বেশি জল ব্যবহার করে। আগামী 25-30 বছরে জলের চাহিদা 2-2½ গুণ বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং জলের জন্য দ্বন্দ্ব হওয়া স্বাভাবিক ।
(7) আগামী 10-15 বছরের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় 200 কোটি মানুষ জলই পাবে না। বর্তমানে প্রায় 200 কোটি মানুষের উপযুক্ত শৌচ ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থায় জল সংরক্ষণ না হলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে।
ভারতবর্ষের জল দ্বন্দ্ব : ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে জলবিবাদ আরম্ভ হয়েছে। রাষ্ট্রসংঘ (UN) 2008 সালকে আন্তর্জাতিক স্যানিটেশন বর্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, কিন্তু জলসমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সমস্যা : বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গা-পদ্মা জলবিবাদ সমস্যা-সঙ্কুল অবস্থায় রয়েছে। ফারাক্কা ব্যারেজের মাধ্যমে জল নিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক চুক্তি নিয়ে নানা সময়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হচ্ছে।আন্তঃরাজ্য বিবাদ :
(1) পাঞ্জাব ও হরিয়ানাতে সবুজ বিপ্লব হওয়ায় কৃষিকার্যে প্রচুর পরিমাণে ভৌমজল জলসেচ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে জলস্তর প্রায় 30 মিটারের নীচে নেমে গেছে। তীব্র জলসঙ্কটের মধ্যে তাই দুটি রাজ্যের মধ্যে শতদ্রু ও যমুনা নদীর যোগাযোগকারী ক্যানেল তৈরি ও জলবন্টন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে শতদ্রু-যমুনা বিবাদ আরম্ভ হয়েছে।
(2) গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের মধ্যে নর্মদা নদীর উপরে তৈরি সর্দার সরোবর প্রকল্পের জলবন্টন নিয়ে সর্দার সরোবর প্রকল্প বিবাদ সূচিত হয়েছে।
(3) কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু রাজ্যের মধ্যে কাবেরী নদীর জলবন্টন নিয়ে কয়েক দশক ধরে বিবাদ চলছে। কর্ণাটক ভৌগোলিক দিক থেকে কাবেরী নদীর জল নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বিবাদের মীমাংসা নিয়ে সমস্যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
1.9 বাঁধ ও জলাধার তৈরির উপযোগিতা (Benefits of Dams) :
(1) বড়ো বড়ো নদীতে জলাধার নির্মাণ করার ফলে এবং বাঁধ নির্মাণ করার ফলে পূর্বের বন্যা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।
(2) নিয়ন্ত্রিত সেচখালের মাধ্যমে জলাধার থেকে জল নিয়ে দূরে অনুর্বর জমিতে খরাপ্রবণ এলাকায় চাষাবাদ করা সম্ভব। কৃষিকার্যে জলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয়।
(3) জলাধার থেকে জল নিয়ে বা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব।
(4) বাঁধ নির্মাণের ফলে কোনো কোনো জায়গায় মৎস্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
(5) বাঁধ নির্মাণ করে বা জলাধার তৈরি করে দর্শনীয় স্থান হিসেবে পর্যটন ব্যবস্থা ও নৌকাবিহারের ও আমোদ প্রমোদের স্থানও তৈরি সম্ভব। (উদাঃ—ভাক্রা-নাঙ্গাল বাঁধ, হীরাকুদ বাঁধ, বৃন্দাবন গার্ডেন ইত্যাদি)।
1.10 বাঁধ/জলাধার তৈরির সমস্যা (Problems with dams ) :
(1) যে কোনো নদীর উপর বাঁধ তৈরি হলে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। একদিকে বাঁধ দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ হলেও অন্যত্র বন্যার প্রকোপ দেখা দেয়।
(2) বাঁধ নির্মাণের ফলে যে প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটে তাতে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। পুনর্বাসনের সমস্যা প্রকট হয়। উদাঃ নর্মদা নদীর ওপরে নর্মদা ভ্যালি প্রজেক্ট ও সরদার সরোবর বাঁধ।
(3) বাঁধ নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণের ফলে অরণ্য ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এর ফলে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়, জীবজন্তু আবাসস্থল হারিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ে। সাইল্যান্ট ভ্যালি আন্দোলন এ কারণে সংঘটিত হয়।
(4) জলাধার নির্মাণের ফলে ভূমিক্ষয়ের সম্ভাবনা দেখা দেয়। আবার বর্ষার সময়ে হঠাৎ অতিরিক্ত জল ছেড়ে দেওয়ার ফলে নিম্নভূমিতে কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি হয়।