পরিবেশ নৈতিকতা
পরিবেশ নৈতিকতা : সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধান (Environmental Ethics : Issues and possible solutions)
স্টকহোম অধিবেশন, ভিয়েনা কনভেনশন, রিও সম্মেলন প্রভৃতি আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংক্রান্ত সম্মেলনে গৃহিত পরিবেশ নীতির মূলকথা হল পরিবেশ সুরক্ষা করা ও পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
এর নিয়মাবলীগুলি হল—
(1) স্বাধীনতা, সমতা ও উপযুক্ত জীবনযাপনের পরিবেশ সৃষ্টি করা। বর্ণবৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা, সব রকম নিপীড়ন ও বিদেশিদের আগ্রাসী নীতিগুলি খুব নিন্দনীয় এবং এদের অবসান দরকার।
(2) বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা, সম্পদের অতি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা।
(3) পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক দূষিত পদার্থের উৎপাদন বন্ধ করা ও উৎসগুলি ধ্বংস করা।
(4) জনসংখ্যা পরিকল্পনা নীতি গ্রহণ করা।
(5) পরিবেশ সমস্যা সমাধানের জন্য পরিবেশ সংক্রান্ত প্রযুক্তি প্রয়োগ করা।
(6) বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে পরিবেশের উন্নতি করা।
(7) পরিবেশনীতি অনুযায়ী দূষণকারী রাষ্ট্রকে দূষণ ব্যয় বহন করতে হবে।
(8) পরিবেশনীতি অনুসরণ করে সুস্থায়ী উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক প্রয়াসে শিল্পোন্নত দেশগুলি তাদের দায়িত্ব পালন করবে।
(9) যুদ্ধকালীন অবস্থায় পরিবেশ সুরক্ষা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন যুদ্ধরত দেশগুলিকে মান্য করতে হবে।
পরিবেশ নীতি রূপায়ণের প্রথম কথা হল—প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা তার জন্মগত অধিকার। নির্মল পরিবেশে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে শোষণমুক্ত অবস্থায় প্রত্যেকে বাঁচবে। ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবেশ নীতি রূপায়ণের পরিপন্থী। বিপুল জনসংখ্যার চাপের সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদের যোগান সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার, সচেতনতার অভাব ভারতবর্ষের পরিবেশ নীতি রূপায়ণের পক্ষে প্রতিবন্ধক। দেশের সরকার পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়মনীতি প্রণয়ন করলেও তা রূপায়ণের বিষয়ে পরিকল্পিতভাবে ও কঠোরভাবে ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট হতে হবে। জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি না করলে শুধু আইন প্রণয়ন করে পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয়।
পরিবেশ নীতি বলতে কি বোঝায় ?
নীতি কথাটির অর্থ সুনিয়ম বা সুবিধি। পরিবেশ যেহেতু পৃথিবীর সকল জীবের সুস্থ ও স্বাভাবিক বেঁচে থাকার স্থান তাই পরিবেশ যাতে বিনষ্ট না হয়, তার জন্য ব্যবস্থা তথা নীতি থাকা প্রয়োজন। সভ্যতার প্রথমে মানুষ সামাজিক শাসনের মাধ্যমে এবং ধর্মীয় রীতির সাহায্যে পরিবেশকে রক্ষা করার নিয়ম মান্য করত। বনদেবতার পূজা, আগুনকে দেবতারূপে মেনে নেওয়া, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরিবেশকে রক্ষা করার ভাবনা ছিল।
পরিবেশ নৈতিকতা রূপায়ণে সমস্যা :
পরে মানবজাতি ব্যবসা-বাণিজ্যে যত উন্নত হয়েছে, যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে রাজ্য জয় করেছে, ততই দেশজ রীতিনীতিগুলি ধ্বংস হয়েছে, ক্ষমতাশালী দেশ ও মানুষের আমদানি করা নতুন প্রথা, পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পরিবেশদর্শী নিয়মবিধি চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে।
শিল্প ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে পরিবেশে নানা কুফল ধরা পড়েছে, মানুষ নতুন করে নিজের ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা শুরু করেছে। সেই ত্রুটি সংশোধনের মধ্য দিয়েই পরবর্তীকালে আরও ভালো কাজের পথ তৈরি হতে পারে। পরিবেশনীতি প্রস্তুত করা বা পরিবেশ সুরক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করা মানুষের প্রয়োজনীয় কাজগুলির মধ্যে এক সুদূরপ্রসারী গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
পরিবেশ নৈতিকতা বিষয়ক সম্ভাব্য সমাধান :
প্রতিটি মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মেছে। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা তাই তার জন্মগত অধিকার। এই বেঁচে থাকার পথে মানুষ নিজের সমাজ-সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং নির্মল পরিবেশে সুস্থ ও স্বাভাবিক মানবজীবন অতিবাহিত করবে (Universal Declaration of Rights ) । মানুষ সবরকম শোষণ থেকে মুক্ত থাকবে।
ভারতবর্ষ উন্নয়নমূলক দেশসমূহের অন্যতম। ভারতবর্ষের জনসংখ্যা বিপুল। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনে ভারতের জৈব বৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে, পরিবেশ দূষণের তোয়াক্কা না করে অপরিকল্পিত উপায়ে শিল্পায়ন, নগরায়ণ হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে পরিবেশ নিয়ে খুব একটা কেউ মাথা ঘামায় না। সরকারও অনেকক্ষেত্রে উদাসীন। এককথায় ভারতে পরিবেশনীতি প্রণয়ন একান্ত জরুরি। কিন্তু বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে কঠোরতা ও সহৃদয়তা থাকা প্রয়োজন।
রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গঠন করা, দূষণ প্রতিরোধে গ্রীন বেঞ্চ গঠন করা, জাতীয় জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। পরিবেশচেতনা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সংগঠনগুলি গড়ে তুলে জাতীয় ও রাজ্যস্তরে গৃহীত পরিবেশনীতিগুলি রূপায়ণের প্রচেষ্টা চলছে। প্রশাসনিকভাবে আরো কঠোরতা না আনলে নীতি প্রণয়ন সম্ভব হবে না ।
অপরদিকে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও দেশের তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান বা চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সরকার ও প্রশাসনিক মহল যে সমস্ত পরিকল্পনা বা প্রকল্প গ্রহণ করেন তা অনেক সময় পরিবেশবান্ধব হয় না। এ বিষয়ে অনেক স্বেচ্ছাসেবী - সংস্থা (N.G.O) এবং জনগণের আন্দোলন সরকারের হুঁশ ফেরাতে সাহায্য করে।