সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র
সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র (Marine Ecosystem) :
(1) পৃথিবীর মোট জলভাগের 97.5 শতাংশ হল সমুদ্র । পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় 70 ভাগ সমুদ্র । প্রতিটি সমুদ্র পরস্পর সংযুক্ত ।
(2) সমুদ্রের গভীরে রহস্যময় এক পরিবেশ রয়েছে । ভূপ্রকৃতিগতভাবে গভীরতায় যেমন তারতম্য অয়েছে তেমনি উষ্ণতা, লবণাক্ততাও ভিন্ন ভিন্ন ।
(3) মেরু প্রদেশে বরফ শীতল ঠান্ডা আবার নিরক্ষীয় অঞ্চলে উত্তপ্ত । এর ফলে নানা প্রকার সমুদ্রস্রোতে সমুদ্রের বুকে দেখা যায় । কুমেরু স্রোত, সুমেরু স্রোত, নিরক্ষীয় স্রোত, জাপান স্রোত প্রভৃতি শীতল ও উষ্ণস্রোত প্রশান্ত মহাসাগরে দেখা যায় ।
(4) সমুদ্রের বুকে ভিন্ন ভিন্ন স্রোতের মাঝে শৈবাল সাগর, হিমপ্রাচীর ইত্যাদি দেখা যায় । গ্র্যান্ডব্যাঙ্ক নামক অগভীর মগ্নচড়াই আমেরিকার উপকূলের (উত্তর-পূর্ব) মহীসোপান অঞ্চলে অবস্থিত । প্রচুর জৈবপ্রদার্থ, প্ল্যাঙ্কটন ও মৎস্যে পরিপূর্ণ গ্রান্ডব্যাঙ্ক এক বিস্ময়কর সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ।
(5) সমুদ্রে জলে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম লবণ থাকায় (ppm) এর জল নোনতা ।
(6) সূর্য ও চন্দ্রের আকর্ষণে সমুদ্রের বুকে অনবরত জোয়ার ভাটার সৃষ্টি হয় এবং জল আলোড়িত হয় ।
সমুদ্রতলের ভূমিরূপকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায় । যথা-
মহাসাগর তলের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ
A = বেথিয়াল অঞ্চল B = অ্যাকাই সোল অঞ্চল C = হ্যাডাল (aphotic) অঞ্চলে
(ক) মহাদেশীয় প্রান্তভাগ (Continental Margins) :
(1) মহীসোপান (Continental Shell) : দুই ভাগে বিভক্ত (1) জোয়ার-ভাটা অঞ্চল (Intertidal or Littoral zone), (2) নেরিটিক অঞ্চল (মহীঢাল পর্যন্ত অঞ্চল) ।
(2) মহীঢাল (Continental slope), (3) মহাদেশীয় ক্রমোচ্চ ভূমিভাগ (Continental Rise) ।
(খ) গভীর সমুদ্রের সমভূমি (Deep Sea Plain) :
(1) অতল গহ্বর সমভূমি (Abyssal plain)
(2) অন্তঃসাগরীয় শঙ্কু আকৃতির পাহাড় বা ঢিলা ও গ্যায়ট (Sea Mounts and Gayot) ।
(গ) সামুদ্রিক শৈলশিরা ও উচ্চভূমি (Oceanic Ridges and Rises) ।
(ঘ) গভীর সমুদ্রখাত (Deep-sea Trenches) ।
(ঙ) সামুদ্রিক দ্বীপামালা (Island Arcs) ।
(চ) প্রান্তীয় সামুদ্রিক (Marginal Ocean Basin) ।
(ছ) সামুদ্রিক মালভূমি (Sub-marine plateau) ।
সমুদ্রের গভীর ও অগভীর বিভিন্ন অঞ্চলের পরিবেশ ভিন্ন ভিন্ন হয় । অপেক্ষাকৃত উপকূলবর্তী অঞ্চলে (মহীসোপান) জোয়ার-ভাটার মধ্যবর্তীস্থানে বেন্থস প্রাণীদের বসবাস । মহীসোপান ও মহীঢাল অংশ যা Continental rize অংশে শেষ হয়েছে তাকে নেরিটিক অঞ্চল বলে । এই স্থানটি অপেক্ষাকৃত কম গভীরতাসম্পন্ন এলাকা । এরপর Oceanic Region এর তিনটি অংশ হল বেথিয়াল অঞ্চল (A), অ্যাবইসাল অঞ্চল (Abyssal region), (B) এবং হ্যাডাল বা আলোকবিহীন অঞ্চল (C) ।
মহীসোপান অঞ্চলে সমুদ্রের তটরেখা থেকে 200 মিটার গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত । এই অঞ্চলে গভীরতা গড়ে 78 মিটার, এর ঢাল 1° থেকেও কম । মোট সমুদ্রপৃষ্ঠের 76% হল মহীসোপান । জোয়ার-ভাটার এই অঞ্চলের নিম্নভাগের তলদেশে বহু প্রাণী বসবাস করে ।
উৎপাদক :
সমুদ্রের প্রচুর ভাসমান ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন, (ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণা), ডায়াটম, লাল ও সবুজ শৈবাল, আগাছা থাকে । এরাই উৎপাদক হিসাবে কাজ করে ।
খাদক :
(1) জু প্ল্যাঙ্কটন (Zoo plankton) : জলে ভাসমান প্রাণীকণা (যেমন প্রোটোজোয়া), সাল্পা (Salpa), টিনোফোরা (Ctenophora), ক্রাস্টেসিয়া (Crastacea), কপিপোড (Copepod থাকে) উদ্ভিদকণাকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে ।
(2) বেন্থস (Benthas) : জোয়ার-ভাটার ঊর্ধ্ব ও নিম্ন অঞ্চলে সমুদ্রের তলদেশে বেশ কিছু প্রাণী মোটামুটি স্থিরভাবে থাকে । ঝিনুক, শামুক, প্রবালকীট, সি-অ্যাশিমন উল্লেখ্যযোগ্য । সমুদ্রের জলে মিশে থাকা বিভিন্ন খাদ্যকণা এরা গ্রহণ করে ।
(3) নেকটন (Nekton) : এরা সমুদ্রের মধ্যস্তরে সাঁতার কেটে ঘুরে বেড়ায় । চিংড়ি, কচ্ছপ, তিমি, শীল মাছ এই শ্রেণিভুক্ত । গভীর সমুদ্রের এলাকার প্রাণীদের মধ্যে সি-আর্চিন যেমন থাকে, তেমনি কিমেরা, হেরিওট্টা, ফোটোস্টেমিয়াস, ক্রিস্টোসেরাস, হেটারোস্টোমাটা গোত্রের মৎস্য থাকে । গভীর সমুদ্রের মাছের দেহ জলের চাপে চ্যাপ্টা হয় । সামুদ্রিক চাপ প্রতি 1000 ফ্যাদম গভীরতায় 1 টন/বর্গ ইঞ্চি বৃদ্ধি পায় । অন্ধকার অঞ্চলে থাকার কারণে কোনো কোনো প্রাণীতে যেমন ক্রাস্টেসিয়া বা সেকালোপাড প্রভৃতিতে বায়োলুমিনিসেন্স (Bioluminescence) বা জৈব আলো দেখা যায় । এই প্রকার আলো খাদ্য ধরতে ও যৌন মিলনে সাহায্য করে । আরগুলাস নামক প্রাণী অন্য প্রাণীর দেহে আটকে থেকে খাদ্য গ্রহণ করে ।
বিয়োজক (Decomposer) :
বিভিন্ন প্রকার ব্যাকটিরিয়া, ছত্রাক বিয়োজকের কাজ করে । সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে উৎপাদক প্রচুর থাকায় খাদ্যকণার কোনো সমস্যা থাকে না । প্রাথমিক খাদক হিসেবে জু-প্ল্যাঙ্কটন অগ্রগণ্য । গৌণশ্রেণির খাদক হল ছোটো মাছ, চিংড়ি, সি-অ্যাসনিমন ইত্যাদি । সর্বোচ্চ শ্রেণির খাদক হল বিভিন্ন মাছ, তিমি, হাঙ্গর (তরুণাস্থিবিশিষ্ট মাছ) উল্লেখযোগ্য ।