ব্রিটিশ শাসনকালে শাসনতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা (১৮৫৭-১৯৪৭)(Constitutional Experiments under the British Crown)
ভারতশাসন আইন, ১৮৫৮
কোম্পানির শাসনের অবসান হয় এবং ব্রিটিশ রাজের সূচনা হয়।
দ্বৈত শাসনব্যাবস্থার অবসান হয়। কোর্ট অব ডাইরেক্টর এবং বোর্ড অব কন্ট্রোল-এর অবলুপ্তি ঘটে এবং এর স্থানে সেক্রেটারি অব স্টেট নামে একটি পদ তৈরি হয়, যার স্থলাভিষিক্ত হয় ব্রিটিশ ক্যাবিনেট-এর একজন সদস্য। তাঁকে সহায়তা করত ১৫-সদস্যের একটি পরিষদ (তাকে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল বলা হত)। তিনি ব্রিটিশ রাজের হয়ে ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন।
সেক্রেটারি অব স্টেট গভর্নর জেনারেল-এর মাধ্যমে ভারতবর্ষ শাসন করতেন।
গভর্নর জেনারেল ‘ভাইসরয়’ উপাধি পান। তিনি সেক্রেটারি অব স্টেট এর প্রতিনিধিত্ব করতেন এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে গঠিত একটি কার্যনির্বাহী পরিষদ তাঁকে এই কাজে সহায়তা করত।
একটি একক এবং সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থা তৈরি হয়।
ভারতীয় পরিষদ আইন, ১৮৬১
ভাইসরয়ের এগজিকিউটিভ কাউন্সিল-এ পঞ্চম সদস্য হিসাবে একজন আইনজ্ঞ সংযুক্ত হয়।
এতদিন পর্যন্ত গভর্নর জেনারেলের নির্বাহী প্রিষদে কেবল সরকারি অধিকারিকরাই থাকতেন, এবার এমন ব্যবস্থা করা হল যে, নির্বাহী পরিষদ যখন বিধান পরিষদ হিসাবে কাজ করবে তখন তাতে অতিরিক্ত ৬ থেকে ১২ জন অতিরিক্ত সদস্য যুক্ত হবেন, যেখানে কিছু উচ্চপদস্থ ভারতীয়ও থাকবেন। এইভাবে সরকারের আইন প্রণয়নের পদ্ধতিতে দেশীয় ব্যক্তিদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। যদিও, এই অতিরিক্ত সদস্যদের বিশেষ কোনো ক্ষমতা ছিল না।
নির্বাহী পরিষদ কেন্দ্রীয় বিধান পরিষদ হিসাবে পরিচিত হল।
জরুরি কোনো অবস্থায় ভাইসরয় অধ্যাদেশ জারি করতে পারতেন।
ভারতীয় পরিষদ আইন, ১৮৯২
ভারতীয় ও প্রাদেশিক বিধান পরিষদগুলির ক্ষেত্রে দুটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়-
(ক)যদিও ভারতীয় বিধান পরিষদে সরকারি সদস্যদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা যেমন ছিল তা বজায় থাকবে, কিন্তু বেসরকারি সদস্যদের মনোনীত করবে বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স এবং প্রাদেশিক বিধান পরিষদগুলি। প্রাদেশিক পরিষদগুলির বেসরকারি সদস্যগণ মনোনীত হবেন কিছু স্থানীয় সংস্থা, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা বোর্ড, পৌরসভা ইত্যাদির দ্বারা। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ যেমন জি.কে. গোখলে, আশুতোষ মুখার্জী, রাসবিহারী ঘোষ এবং এস. এন. ব্যানার্জী এইভাবে বিধান পরিষদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন।
(খ) পরিষদগুলির রাজস্ব ও ব্যয় সংক্রান্ত বার্ষিক বিবৃতি (অর্থাৎ বাজেট)নিয়ে আলোচনা করার এবং কার্যনির্বাহকদের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করার ক্ষমতা থাকবে। তারা কোনো জনস্বার্থ বিষয়ে সরকারের কাছে ৬ দিনের নোটিশ দিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনও করতে পারতেন।
ভারতীয় পরিষদ আইন, ১৯০৯ অথবা মর্লি-মিন্টো সংস্কার
মর্লি ছিলেন তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট, এবং মিন্টো ছিলেন ভারতের ভাইসরয়।
কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক বিধান পরিষদগুলির সম্প্রসারণ করা হয়।
কেন্দ্রীয় সরকার প্রিচালনার ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেলের এগজিকিউটিভ কাউন্সিল-এ একজন ভারতীয় সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নির্বাচিত বেসরকারি সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে প্রাদেশিক বিধান পরিষদগুলির আকার বৃদ্ধি করা হয়। এর ফলে সরকারি সংখ্যাধিক্য লোপ পায়। তাদের কাজকর্মের পরিধি বৃদ্ধি পায়। এখন, তারা বাজেট ও জনস্বার্থ বিষয়ক কোনো বিষয়ে সংকল্প উত্থাপন করার ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়।
কেন্দ্রীয় বিধান পরিষদেও নির্বাচনের কথা বলা হয়। কিন্তু সরকারি সংখ্যাধিক্য বজায় রাখা হয়।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা হয় যখন মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা হয়। এরই মধ্য দিয়েই সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের সূচনা হয়।
ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ অথবা মন্টেগু-চেম্স্ফোর্ড সংস্কার
প্রদেশগুলিতে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়। এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা অর্পণের সূত্রপাত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। প্রদেশীয় বিষয়গুলি দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়-হস্তান্তরিত বিষয় এবং সংরক্ষিত বিষয়। হস্তান্তরিত বিষয়গুলি গভর্নর বিধান পরিষদের নিকট দায়ব্দধ মন্ত্রীদের সহায়তার পরিচালনা করতেন। গভর্নর ও তাঁর নির্বাহী পরিষদ (এগজিকিউটিভ কাউন্সিল) সংরক্ষিত বিষয়গুলি পরিচালনা করতেন যদিও বিধান মণ্ডলের কাছে তাঁদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকত না।
ডিভলিউশন রুলস বা ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়মাবলী
প্রশাসনিক বিষয়গুলিকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়-কেন্দ্রীয় ও প্রদেশীয়। সর্বভারতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিশ্য সমূহ (যেমন রেল, অর্থ)কেন্দ্রীয় শ্রেণির আওতায় আনা হয়, অন্যদিকে যে বিষয়গুলি প্রদেশগুলির প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত সেগুলি প্রদেশীয় শ্রেণিভুক্ত করা হয়।
প্রাদেশিক বিধান মণ্ডল ছিল এক কক্ষ বিশিষ্ট (লেজিস্লেটিভ অ্যাসেম্বলি)
গভর্নর জেনারেলের এগজিকিউটিভ কাউন্সিলে (ভারতীয় বিধান মণ্ডল)ভারতীয় সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে মোট আটজন সদস্যের মধ্যে তিনজন করা হয়। ভারতীয় সদস্যদের আইন, শিক্ষা, শ্রম, স্বাস্থ্য ও শিল্প বিষয়ক দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এই প্রথম ভারতীয় বিধান মণ্ডলকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করা হয়। এটি ১৯৩৫ সালের এই আইন বলবত করা হয়েছিল।
সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের বিস্তার বৃদ্ধি করে শিখ, খ্রিস্টান, ইঙ্গ-বঙ্গ-এদেরও অন্তর্ভুলত করা হয়।
সেক্রেটারি অব স্টেটকে ব্রিটিশ রাজের বেতনভুক করা হয়।
ভারত শাসন আইন ১৯৩৫
এই আইনে ব্রিটিশ প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। যেহেতু দেশীয় রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যোগদান ঐচ্ছিক ছিল, তাই যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবে রূপায়িত হয় নি।
কেন্দ্রে দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা চালু হয় (যেমন, বৈদেশিক বিষয়, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি বিষয়গুলি গভর্নর জেনারেলের উপর সংরক্ষিত ছিল)। সংরক্ষিত বিষয়গুলি ছাড়া অন্য বিষয়গুলির ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল বিধানমণ্ডলের কাছে দায়বদ্ধ মন্ত্রীপরিষদের সাহায্যে ও পরামর্শক্রমে কাজ করবেন(দেশীয় রাজ্যগুলির ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ব্যক্তিত্ব এবং কেন্দ্রীয় বিধানমণ্ডলের কাছে দায়বদ্ধ)। অবশিষ্ট ক্ষমতা গভর্নর জেনারেলের হাতেই ন্যস্ত ছিল।
কেন্দ্রীয় বিধানমণ্ডল ছিল দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট-যুক্তরাষ্ট্রীয় বিধানসভা ও রাজ্য পরিষদ। রাজ্যপরিষদ ছিল একটি স্থায়ী সংস্থা যার এক তৃতীয়াংশ সদস্যদের প্রতি তিন বছর অন্তর পদত্যাগ ও পুনর্নবীকরণের মাধ্যমে সদস্যপদ পূরণ করা হত। যুক্তরাষ্ট্রীয় বিধানসভার সময়কাল ছিল পাঁচ বছর।
এই আইনে বিধানিক ক্ষমতার তিন রকম বিভাজন করা হয়-যুক্তরাষ্ট্রীয় বিধানিক সূচি, প্রাদেশিক বিধানিক সূচি এবং সমবর্তী বিধানিক সূচি। বিধি প্রণয়নের অবশিষ্ট ক্ষমতা গভর্নর জেনারেলের উপর ন্যস্ত ছিল। কেন্দ্রীয় বিধানমণ্ডল কর্তৃক গৃহীত কোনো বিষয়কে গভর্নর জেনারেলের ভেটো প্রয়োগ করার ক্ষমতা ছিল। আবার গভর্নর জেনারেলের আদেশে তৈরি হওয়া কোনো আইন ব্রিটিশ সম্রাট ও তাঁর নির্বাহী পরিষদ বাতিল করে দিতে পারতেন।
দ্বৈত শাসনের পরিবর্তে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন-এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল প্রদেশগুলিতে। সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত বিষয়গুলির মধ্যে ব্যবধান বিলুপ্ত করা হয়েছিল। এরা স্বতন্ত্র আইনি স্বীকৃতি লাভ করল।
গভর্নর হলেন প্রধান প্রাদেশিক নির্বাহক এবং তিনি অভিজ্ঞ মন্ত্রীমণ্ডলীর পরামর্শক্রমে কাজ করতেন। যদিও এই আইনের বলে গভর্নর কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁর স্বেচ্ছানুসারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
এই আইনে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত স্থাপন করার কথা বলা হয়, যা ১৯৩৭ সালে স্থাপিত হয়। সেই আদালত মূল ও উত্তরবিচারের অধিকার সম্পন্ন ছিল এবং সংবিধান ব্যাখ্যা করতে পারত। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যাংক (ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক) ও স্থাপন করা হয়। সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া পদটির বিলোপ ঘটানো হয়।
প্ররথক নির্বাচক মণ্ডলীর নীতি বিস্তৃত করে ইঙ্গ-বঙ্গীয়, ভারতীয় খ্রিস্টান ও ইউরোপীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বর্মা (বর্তমান মায়ানমার)এবং এডেন ভারতবর্ষ থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং উড়িষ্যা ও সিন্দ নামে দুটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়।