তুঘলক বংশ
তুঘলক বংশ
গিয়াসুদ্দিন তুঘলক (১৩২০-২৫)
প্রতিষ্ঠাতা ছিল গিয়াসুদ্দিন তুঘলক। আসল নাম-গাজী মালিক। তার পিতা কুরউনাহ তুরকস এর নাম অনুসারে কুরউনাহ তুরক বংশ নামে পরিচিত ছিল। দিল্লি শাসকদের মধ্যে তুঘলক বংশ সবচেয়ে বেশি সময়, ৯৪ বছর রাজত্ব করেছে।
সেচ ব্যবস্থা শুরু করেন গিয়াসুদ্দিন তুঘলক।
গিয়াসুদ্দিন এর সময় মোঙ্গলরা ২৯ বার ভারত আক্রমণ করে।
তার সময় সুফি সাধক শেখ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার আবির্ভাব ঘটে।
১৩২৫ খ্রিঃ প্রাসাদের এক অংশ ভেঙে তার মৃত্যু হয়। সে সময় মরক্কো পর্যটক ইবন বতুতা তাঁর রাজত্বে উপস্থিত ছিলেন। তার পুত্র জুনা খাঁ সিংহাসনে বসেন।
মহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১)
তার প্রকৃত নাম ছিল জুনা খাঁ।
ভারতের ইতিহাসে মহম্মদ বিন তুঘলক বিশেষভাবে পরিচিত। তার পরিকল্পনা গুলির জন্য তিনি ইতিহাসে পাগলা রাজা নামে খ্যাত-
দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি। গঙ্গা ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলকে দোয়াব বলা হয়। এই অঞ্চল অনেক বেশি উর্বর বলে এই অঞ্চলে কর বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু তখন ওই অঞ্চলে খরা বা বন্যার ফলে উৎপাদন কমে যায় যার ফলে তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
রাজধানী স্থানান্তর করেন। তিনি দিল্লি থেকে রাজধানী স্থানান্তর করেন দেবগিরিতে। তার নাম রাখেন দৌলতাবাদ। কারণ দৌলতাবাদ ছিল তার সাম্রাজ্যের মধ্যস্থানে অবস্থিত। কিন্তু সরকারি স্থানান্তরের সময় তিনিত দিল্লির সমস্ত কর্মচারী সহ সহকারী অধীবাসীদেরও দেবগিরি নিয়ে যান যার ফলে সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং দুই বছর পর রাজধানী দিল্লিতে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন।
তামার নোট প্রচলন। তিনি ভারতের প্রথম সম্রাট যিনি প্রতিকি মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন। তিনি তামার নোট চালু করেন। সোনা ও রূপার মুদ্রার বিনিময়ে এই তামার মুদ্রা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তার ধারণা ছিল সোনা ও রূপার মুদ্দ্রা তার কোশাগারে জমা হবে কিন্তু সাধারণ জনগণ খুব সহজেই এই মুদ্রা তৈরি করে ফেলল। যার ফলে প্রচুর ক্ষতি হয় এবং কোশাগার শূন্য হয়ে যায়।
তার অপর পরিকল্পনা ছিল কারজালা। কারজালা প্রকল্পে তিনি কুয়েমান পর্বত ও হিমাচল প্রদেশের সাম্রাজ্যের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কিন্তু তার সাম্রাজ্যে পৌঁছানোর পূর্বে সব শেষ হয়ে যায়।
তার সাম্রাজ্যের শেষের দিকে দক্ষিণ ভারতে তিনটি রাজ্য বিজয় নগর, বাহমণি সাম্রাজ্য ও মাদুরার সুলতানরা স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করেন।
তিনি কৃষি উন্নয়নের জন্য দেওয়ান-ই-কোহী গঠন করেন।
তিনি কৃষকদের ঋণ দেওয়ার জন্য দাগ নামক কৃষিঋণ (তাকাবি)চালু করেন।
তিনি আরবি ও পারসি দুটো ভাষাতেই পারদর্শী ছিলেন। তিনি দর্শন, এ্যাট্রনমি, লজিক ও গণিতে পারদর্শী ছিলেন। তিনি একজন ভালো কলিগ্রাফার ছিলেন।
তার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তার তুতো ভাই বাহাউদ্দিন, তিনি দাক্ষিণাত্যের গুলবার্গের শাসক ছিলেন।
বিখ্যাত মরক্কোর পর্যটক ইবন বতুতা ওই সময় ১৩৩৪ খ্রিঃ ভারতে আসেন। তিনি আট বছর ভারতে ছিলেন। তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ সফর নামা (বলা হয় Rehla)আরবি ভাষায় রচিত হয়েছিল।
বি.দ্র- দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তার ঘটেছিল মহম্মদ বিন-তুঘলকের সময়। তার সাম্রাজ্য ২৩টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল।
ফিরোজ শাহ তুঘলক (১৩৫১-১৩৪৪)
ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন মহম্মদ বিন-তুঘলকের খুল্লতাত ভ্রাতা। তাকে সুলতান সাম্রাজ্যের আদর্শ সম্রাট বলা হয়।
তিনি প্রতিদিন ক্ষমা করার চেষ্টা করতেন। তার শাসন ব্যবস্থায় শাস্তি হিসাবে মুন্ডছেদ বা অঙ্গছেদ প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি কৃষি উন্নয়নের জন্য চাষিদের বিভিন্নভাবে সাহায্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই কৃষি পদ্ধতিকে চারটি ভাগে বিভক্ত করেন।
তিনি ‘ইকতে দারি’ প্রথা চালু করেন। সেনাবাহিনী এই প্রথার সাহায্য পেত। সেনা জমি এবং নগদ অর্থ পেত।
তার প্রচলিত কিছু কর কাঠামো-
১. খরাজ- চাষের জমির ফসলে ১/১০ অংশ কর দিতে হয়।
২. জিজিয়া- এই কর শুধুমাত্র অমুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য।
৩. জাকাত- শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর ২.৫ শতাংশ কর।
৪. খামস্- লিন্ঠিত ও খনিজ দ্রব্যের ১/৫ অংশ।
ফিরোজ শাহের তৈরি চারটি নতুন শহর হিসাব, ফতেহাবাদ, ফিরোজাবাদ (বর্তমান ফিরোজ শাহ কোটলা) এবং হাউনপুর।
তিনি চিকিৎসাব্যবস্থার জন্য দিল্লিতে দার-উল-সাফা নামক দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন।
তিনি তার রাজধানী ফিরোজাবাদে স্থাপন করেন।
তিনি প্রথম শাসক যিনি বেকারদের জন্য এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ চালু করেন। এই সময় রতিবি নামক খাদ্য সামগ্রি তৈরির কারখানা ও গয়ের রতিবি নামে পোশাক ও অন্যান্য সামগ্রি তৈরির কারখানা ছিল।
ফিরোজ শাহ ১৩৬০ খ্রিঃ পুরীর জগ্ননাথ ও কাংড়ায় জ্বালামুখী মন্দির ধ্বংস করেন।
তিনি ক্রিতদাসদের উদ্ধার করেন (প্রায় ১,৮০,০০০ ক্রিতদাস)। এই ডিপারমেন্টের নাম দেওয়া হয় দেওয়ান-ই-বন্দেগান।
তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘ফতুহাত ফিরোজশাহী’।
বারাণী এই সময়ের বিখ্যাত ঐতিহাসিক। তারা দুটি মূল্যবান গ্রন্থে ফিরোজ শাহের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। বই দুটি হল তারিখ-ই-ফিরোজশাহী ও ফতুয়াই-ই-জাহানদারী।
তিনি দুটি নতুন মুদ্রা প্রচলন করেন একটি হল অবৈ (৫০ শতাংশ জিতল)অপরটি বিখ্ (২৫ শতাংশ জিতল)। এগুলো সব রূপার মুদ্রা।
পরবর্তী তুঘলক সম্রাট
ফিরোজ শাহের পর তার পৌত্র ছিল সফলতম সম্রাট যিনি গিয়াসুদ্দিন তুঘলক শাহ-২ নাম ধারণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন শক্তিশালী ও বাস্তব চিন্তাধারার ব্যক্তি। তিনি তার সাম্রাজ্যকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করেছিলেন।
গিয়াসুদ্দিন কে সিংহাসন চ্যুত করে আবু বকর শাহ ১৩৮৯ সিংহাসনে বসেন।
১৩৯০ খ্রিঃ আবু বকরকে সিংহাসন চ্যুত করে নাসিরউদ্দিন মুহম্মদ শাহ-৩ সিংহাসনে বসেন। ১৩৯৪ খ্রিঃ রোগগ্রস্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। তিনি ছিলেন তুঘলক বংশের শেষ সম্রাট।
নাসিরউদ্দিন মহম্মদের শূন্যতার সময় তৈমুরলঙ্গ ভারত আক্রমণ করেন।
তৈমুরলঙ্গের ভারত অভিযান
তিনি ছিলেন মধ্য এশিয়ার বিখ্যাত মঙ্গল বীর। তিনি মাত্র ৩৩ বছর বয়সে চাঘতাই তুর্কি সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন। ভারতবর্ষ আক্রমণের পূর্বে তিনি মেসোপটেমিয়া ও আফগানিস্তান জয় করেন। তিনি ১৩৯৮ খ্রিঃ ডিসেম্বরে দিল্লি আক্রমণ করেন। সে সময় দিল্লির শাসক ছিলেন নাসিরউদ্দিন মহম্মদ।
তৈমুরলঙ্গ ভারত আক্রমণ করে লুটপাট রাহাজানি করে প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে যান।
তিনি ভারত আক্রমণ করার পর বলেছিলেন-“More misery than had before been inflicted by any conqueror in a single invasion.” তৈমুরের দিল্লি আক্রমণের ফলে তুঘলক রাজবংশ সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং তুঘলক শাসনের অবসান ঘটে।