গভর্নর জেনারেল
লর্ড হেস্টিংসের আমলে প্রথম ইংরেজ মারাঠা যুদ্ধে (1776-1782) সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছিল ‘সলবাই চুক্তি’র সৌজন্যে এবং দ্বিতীয় ইংরেজ-মহীশূর যুদ্ধ থামাতে হয়েছিল ‘ম্যাঙ্গগালোর চুক্তির’ জন্য 1784 খ্রিস্টাব্দে লর্ড হেস্টিংস বিস্তার পারদর্শিতার জন্য। বাংলায় এশিয়াটিক সোসাইটির পত্তন করেছিলেন উইলিয়াম জোনসের সহায়তায় 1784 খ্রিস্টাব্দে। তিনি গীতার ভূমিকাটি চার্লস উইলকিন-এর দ্বারা ইংরেজি অনুবাদে লিখিয়াছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে উপঢৌকন নেবার মিথ্যা অভিযোগে সাত বৎসর মামলা চলে। অবশেষে তিনি মুক্তি পান।
দ্রষ্টব্য- স্যার জন ম্যাকফারসন 1785-1786 এই এক বৎসরকাল সাময়িক ভাবে গভর্নর জেনারেলের কাজ চালিয়েছিলেন।
লর্ড কর্নওয়ালিস (1786-1793)
ইনি বাংলায় স্থায়ী উপনিবেশ বা জমিনদারি প্রথা চালু করেছিলেন। প্রথম তিনিই আইনকে সংকলক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এই সারসংকলন রাজস্ব প্রশাসন এবং ন্যায়নীতি প্রশাসনকে আলাদা করেছিল। পুলিশ প্রশাসন-প্রত্যেক জেলাকে 400 বর্গ মাইলে বিভক্ত করেছিলেন এবং প্রত্যেক ভাগে একজন করে সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও তাঁহার সহযোগে কিছু কনস্টেবল থাকত। সরকারি জনপালন কৃত্য তাঁর আমলে প্রাধান্য পেয়েছিল।
স্যার জন সোর (1793-1798)
এই আমলে তেম্ন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে নি।
লর্ড ওয়েলেসলি (1798-1805)
তিনি বাধ্যতামূলক মিত্রতা বা সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স সিস্টেম প্রয়োগ করে ভারতীয় রাজা এবং জমিদারদের আইনের দ্বারা শৃঙ্খলিত করেছিলেন ব্রিটিশ শক্তিকে কায়েম রাখবার স্বার্থে। 1799 খ্রিস্টাব্দে তিনি চতুর্থ ইংরেজ-মহীশূর যুদ্ধে টিপু সুলতানের সৈন্যকে পরাস্ত করেছিলেন।
অধীনতামূলক চুক্তি বা সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স
ভারতের রাজ্যের রাজাদের ব্রিটিশ রাজনীতি ক্ষমতার অধীনে রাখবার প্রয়াসে ওয়েলেসলি এই প্রথার প্রবর্তন করেন। এই প্রথা কোম্পানির বিস্তারে এবং নতুন অঞ্চল সংযোগের ক্ষেত্রে প্রবল সহায়ক হয়েছিল। এই চুক্তির চারটি স্তর ছিল। প্রথমটি, বন্ধুস্থানীয় কোনো যুবরাজকে কোম্পানির নিজস্ব কিছু সৈন্য প্রদান যাতে যুবরাজ কিছুটা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। দ্বিতীয়টি, কোম্পানি নিজস্ব সৈন্য নিয়ে অপর কোনো অঞ্চলের দখল নেবার প্রয়াসে কোনো মিত্র রাজার সহযোগিতা কামনা করা যাঁর ওই অঞ্চলের দখল নেবার প্রয়াসে কোনো মিত্র রাজার সহযোগিতা কামনা করা যাঁর ওই অঞ্চলের রাজাদের সঙ্গে আগে থেকেই শত্রুতা বর্তমান। তৃতীয়টি, ভারতীয় মিত্রর নিকট যুদ্ধের জন্য সৈন্য নয় কাঞ্চন বা টাকাকড়ি দাবি করা। কোম্পানি কিছু সৈন্যকে একজন ইংলিশ অফিসারের নেতৃত্বে ট্রেনিং দিয়ে তৈরি রাখত এবং সেই পলটনটিকে দরকারে ভারতীয় রাজাদের কাছে পাঠানো হত বিনিময়ে কোম্পানি রাজাদের নিকট থেকে সৈন্যদের মূল্য বা ভাড়া বাবদ টাকা আদায় করত। চতুর্থটি, একটি নৈয়ায়িক স্তর। কোম্পানি কোনো বন্ধু রাজার সঙ্গে সখ্যতার প্রমাণ স্বরূপ নিজের একদল সৈন্য রাজার রাজ্যের পরিধি জুড়ে মোতায়েন রাখত শত্রুপক্ষের সাথে মোকাবিলা করার জন্য। এর জন্য রাজাকে কিছুই দিতে হত না কিন্তু সৈন্য দেখাশোনা বা চালনা করবার খরচের জন্য কোম্পানি রাজাকে তাঁর রাজ্য সমর্পণ করতে আদেশ করত।
এক রাজ্যকে অন্য রাজ্যের সঙ্গে কোনো ব্যাপারে আলোচনা করতে হলে কোম্পানির আদেশ সাথে রাজ্যকে তার কার্যালয়ে একজন ব্রিটিশ নাগরিককে রাখতে হত এবং তাঁর সাথে একদল ব্রিটিশ সৈন্য মোতায়েন থাকত এবং সমস্ত খরচা সেই রাজ্যের রাজাকে বহন করতে হত। এর ফলে রাজ্যের সব ক্ষমতা খর্ব হত, ব্রিটিশরাই তাদের রক্ষাকর্তারূপে কাজ করত। বহু রাজ্যের রাজারা এই প্রথা মেনে নিয়েছিলেন যেমন হায়দ্রাবাদের নিজাম, মহীশূরের শাসক, তানজোড়ের রাজা, অবধের নবাব, পেশোয়ারের রাজা, ভোঁসলে বেবারের রাজা, সিন্ধিয়া, যোধপুরের রাজপুতেরা, জয়পুরের শাসক।
ভূমি রাজস্ব প্রথা
চিরস্থায়ো বন্দোবস্ত (জমিনদারি সিস্টেম)
লর্ড কর্নওয়ালিস 1793 খ্রিস্টাব্দে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় এবং বেনারসের কিছু জেলায় এবং চেন্নাই রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেছিলেন, জন সোর এর নকশাটি করেছিলেন। জমিদাররাই জমির মালিক, এটাই ঘোষণা করা হয়েছিল। সুতরাং রাজস্ব আদায়ের ভাগের 1/11 অংশ জমিদারদের কাছে থাকত এবং বাকি দশ ভাগ ব্রিটিশদের ঝুলিতে ভরতে হত। জমিদাররাই জমির দর-দাম সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যের নিষ্পত্তি করত। তাঁদের জমিদারি অক্ষুণ্ন থাকবে ভেবে বেশিরভাগ জমিদার জমিদারি ছেড়ে শহরে এসে বসবাস শুরু করল এবং সেখান থেকে চাষিদের শোষণ করতে লাগল।
রায়তত্ত্বয়ারি প্রথা
মুম্বাই, চেনাই এবং অসমে এই ব্যবস্থা লর্ড মুনরো চালু করেন এবং চার্লস রিড ইহাকে সমর্থন করেন। এই ব্যবস্থায় সরকারের সঙ্গে রায়ত বা চাষিদের সঙ্গে সোজাসুজি চুক্তি হয়, মাটির গুণাগুণ এবং ফসলের প্রকৃতি দেখে তিরিশ বছরের জন্য রাজস্ব দেওয়ার চুক্তি হয়েছিল। রিকার্ডোর বৈজ্ঞানিক ভাড়া তথ্য অনুযায়ী এই খসড়া তৈরি হয়েছিল। চাষিদের নিরাপত্তা এসেছিল কিন্তু তারা অল্প সময়ের মধ্যেই দেনায় ডুবে যেত।
মহালওয়ারি প্রথা (সিস্টেম)
এটা জমিদারি প্রথার এক আধুনিক রূপ। এটা চালু করা হয়েছিল গাঙ্গেয় উপত্যকায়, নর্থ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট প্রভিন্সে, মধ্য ভারতের কিছু অঞ্চলে এবং পাঞ্জাবে। রাজস্ব আদায় ঠিক হত গ্রাম বা তালুকের সঙ্গে জমির মালিকের। উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে রাজস্ব ঠিক করা হত গ্রামের আঞ্চলিক পরিমণ্ডলভুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে, যারা একটি যুক্ত মালিকানা ঠিক করত যাকে ভাইচারা বলা হত, অথবা কিছু গ্রাম যুক্ত হয়ে মালিকানা ঠিক করত যাকে মহাল বলা হত। রাজস্ব সময়ের সাথে সাথে বদল করা হত।
রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত (51%)*. মহলওয়ারী বন্দোবস্ত (30%) *. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (19%)
জর্জ বারলো (1805-1807)
এই সময়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়নি।
লর্ড মিন্টো (1807-1813)
লর্ড মিন্টোর আমলে 1809 সালে অমৃতসর চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। 1813 সালে সনদ পাশ করা হয়েছিল।
চতুর্থ এবং শেষ ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ হয় (1818)
লর্ড হেস্টিংস (1813-1823)
ইংরেজদের সঙ্গে নেপালের যুদ্ধ 1814 সাল থেকে 1816 সাল পর্যন্ত চলেছিল এবং সাগাউলি চুক্তি দ্বারা 1816 সালে সমাপ্ত হয়েছিল।
লর্ড আমহার্স্ট (1823-1823)
এই সময় তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়নি।
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক (1828-1835)
ইনি কিছু সামাজিক পরিবর্তন এনেছিলেন যেমন 1829 সালে সতীদাহ প্রথা আইন রদ করেছিলেন এবং জালিয়াতি দমন করেছিলেন 1830 সালে। আইন ম্যাকাউলের সহায়তায় দেশের উচ্চশিক্ষার্থে ইংরেজি ভাষা চালু করেছিলেন। শিশুবলি এবং জন্মের পরেই মেয়ে শিশু হত্যা বন্ধ করেছিলেন। 1833 সালের সনদ আইন ঘোষণা হয়েছিল এবং এটাই তাঁকে ভারতের গভর্নর জেনারেলের পদে উন্নীত করে। এর পূর্ববর্তী সময়ে এই পদটিকে ‘বাংলার গভর্নর জেনারেল’ বলা হত।
স্যার চার্লস মেটকাফে (1835-1836)
ভাষাভিত্তিক সবরকম বাধাকে সংবাদ মাধ্যম থেকে তুলে দেন। একে “লিবারেটর অফ প্রেস” নামে অভিহিত করা হয়।
লর্ড অকল্যান্ড (1836-1872)
তাঁর আমলে প্রথম আফগান যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং এই যুদ্ধ ইংরেজদের চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিল।
লর্ড এলেনবরো (1842-1844)
কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে নি।
লর্ড হার্ডিঞ্জ 1 (1844-1848)
তাঁর আমলেও উল্লেখনীয় কিছু ঘটে নি।
লর্ড ডালহৌসী (1848-1856)
তাঁর আমলে প্রথম 1853 সালে মুম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত ভারতীয় রেল চালু হয়। কলকাতা থেকে আগ্রা পর্যন্ত 1853 সালে টেলিগ্রাফ সংযোগ চালু হয়। তিনি ‘ত্রুটি বিচ্যুতির তত্ত্ব’ বা ‘ডকট্রিন অফ ল্যাপস’ এনেছিলেন যার দ্বারা তিনি একাধিক অঞ্চল ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত করেছিলেন যেমন সাতারা (1848), জয়পুর এবং সম্বলপুর (1849), উদয়পুর (1852), ঝাঁসি (1854), এবং নাগপুর (1854)। ডাক বিভাগকে আধুনিক রূপ দিয়েছিলেন যার ফলে দেশের সর্বত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। তিনি PWD এর প্রতিষ্ঠাতা। বহু ব্রিজ নির্মিত হয়েছিল এবং গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোডের কাজ শুরু হয়েছিল। করাচী, মুম্বাই এবং কলকাতা বন্দর নতুন রূপে সজ্জিত হয়েছিল। সিমলাকে তিনি গ্রীষ্মের রাজধানী করেছিলেন। বুরকিতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিজ্ঞান, বনসম্পদ, বাণিজ্য, খনিজ দ্রব্য চর্চা এবং ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচন্ড উদ্যম এনেছিলেন। 1854 সালে উডস ডেসপ্যাচ বিলটি পাশ করেছিলেন যার দ্বারা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সংযোগ সহজতর হয়েছিল। পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুপ্রেরণায় বিধবা বিধবা আইন অনুমোদন লাভ করেছিল উইডো রিম্যারেজ অ্যাক্ট বিলটি 1856 সালে পাশ হবার পর।
ডকট্রিন অফ ল্যাপস
এটি একটি পলিসি লর্ড ডালহৌসী উদ্ভাবন করেছিলেন। তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি রাজা চালিত রাজ্য, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীন সামন্ত সুলভ ব্রিটিশ সহায়তায় পুষ্ট, স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে যায় যদি রাজা অকর্মণ্য হয় অথবা রাজা যদি কোনো নিজ রক্তের উত্তরাধিকারী না রেখে যায়। কোম্পানি এই তত্ত্বের ভিত্তিতেই সাতারা, জয়পুর, সম্বলপুর, নাগপুর, ঝাঁসি এবং আবোধ যুক্ত করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বাড়িয়ে নিয়েছিল। 1857 সালের বিদ্রোহ এই তত্ত্ব প্রয়োগের ফল।