মৌর্য সাম্রাজ্য
মৌর্য রাজবংশ
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (৩২২-২৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্ত নামে পরিচিত চাণক্যের সাহায্যে নন্দবংশকে উৎখাত করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
গ্রিক বুদ্ধিজীবীগণ কর্তৃক চন্দ্রগুপ্ত সান্দ্রোকোট্টাস (Sandrocottus)নামে অভিহিত হন।
আলেকজান্ডারের সৈন্যাধ্যক্ষের মধ্যে একজন ছিলেন সেলুকস নেকাটের এবং তিনি আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর বেশিরভাগ এশীয় দেশগুলির আধিপ্ত্য লাভ করেন। চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে পরাজিত করেন ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং আফগানিস্থানের বেশিরভাগ অংশ চন্দ্রগুপ্তের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। এই দুই বংশ বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিল।
তিনি বিহার এবং বাংলার বৃহদংশ কেবলমাত্র রাজ্যভুক্ত করেননি তার সঙ্গে পশ্চিমাংশ, উত্তর পশ্চিমাংশ এবং দাক্ষিণাত্যও দখল করেন।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভার সেলুকলের দূত মেগাস্থিনিস-এর কাছ থেকে এই তথ্য জানা যায়। আমরাও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এর বিবরণ পাই। চন্দ্রগুপ্ত জৈনধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং ভদ্রবাহুর সঙ্গে মহীশূরের নিকট শ্রাবণ বেলাগোলা গিয়েছিলেন। সেখানেই পরলোকগমন করেন।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে চন্দ্রগুপ্তের শত্রুর বিবরণ সম্বলিত মুদ্রারাক্ষস এবং দেবী চন্দ্রগুপ্তম নামে দুটি নাটক বিশাখাদত্ত রচনা করেন।
বিন্দুসার (২৯৭-২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
গ্রিক লেখকগণ বিন্দুসারকে ‘অমিত্রাঘাত’ নামে অভিহিত করেন।
২৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্তের পুত্র বিন্দুসার উত্তরসূরি হয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন দুই-সমুদ্রের মধ্যবর্তী স্থান তিনি আয়ত্বাধীন করবেন, অর্থাৎ আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের অঞ্চল সমূহ।
তাঁর মৃত্যুর সময়ে প্রায় উপমহাদেশের সমগ্র অঞ্চল তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। গ্রিক দূত ডিমাইকোস তাঁর রাজসভা পরিদর্শন করেছিলেন।
সম্রাট অশোক (২৬৯-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
বাবা বিন্দুসার অশোককে তক্ষশীলা এবং উজ্জয়িনির ভাইসরয় (শাসনকর্তা) হিসাবে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি যখন উজ্জয়িনিতে ছিলেন তখন তাঁর পিতা মারা যান। অমীমাংসিত উত্তরসূরি নির্বাচনের পর রাজ্যাভিষেক চার বছর পিছিয়ে যায়। বৌদ্ধ সাহিত্যে বলা হয় যে তিনি ৯৯ জন ভাইকে হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
সকল সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট হিসাবে তিনি পরিগণিত হন।
শিলালিপির মাধ্যমে জানা যায় যে তিনিই প্রথম সম্রাট যিনি জনসাধারণের সঙ্গে সংস্পর্শ রেখে চলতেন।
তাঁর শিলালিপিতে জানা যায় যে নীচের ভাষাগুলি তখনকার দিনে ব্যবহৃত হত। যেমন-ব্রাহ্মী, খরোষ্ঠী, আরমাইক এবং গ্রিক ভাষা; যেগুলি জেমস প্রিন্সেপ নামে এক পণ্ডিত পাঠোদ্ধার করেন।
অশোক উপগুপ্তের নিকট ধর্মে দীক্ষিত হন।
সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ
তাঁর সাম্রাজ্য হিন্দুকুশ থেকে বাংলা দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং আফগানিস্তান, বালুচিস্তান এবং ভারতের ছোটো অঞ্চল সমূহ যেমন সুদূর দক্ষিণাঞ্চল, কাশ্মীর এবং নেপাল উপত্যকা ছাড়া সমগ্র ভারতে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারলাভ করেছিল।
কলিঙ্গ যুদ্ধ (261 BC, mentioned in XII rock edict):
অষ্টম অনুশাসনে উল্লেখ করা আছে কলিঙ্গ যুদ্ধই অশোকের জীবনে বিরাট পরিবর্তন এনে দেয়; এই যুদ্ধের পর তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন।
অশোকের সাম্রাজ্যের দৃষ্টিকোণসমূহ:
অশোকের সাম্রাজ্য বেশ কিছু প্রদেশে বিভক্ত ছিল এবং প্রতি প্রদেশের একজন করে শাসনকর্তা নিয়োজিত ছিল। তিনি সাম্রাজ্য জুড়ে ধর্মশালা, হাসপাতাল এবং সরাইখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর ও মহিলাদের মধ্যে ধর্মপ্রচারের জন্য ‘ধর্মমহাপাত্র’ নামে ধর্মপ্রচারক নিয়োগ করেছিলেন।
দেশে এবং বিদেশে ধর্মপ্রচারের জন্য এক মিশনারি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি মিশনারিদের (ধর্মপ্রয়োগদের)ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার), থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলগুলিতে পাঠিয়েছিলেন এবং একই উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর পুত্র মহীন্দ্র এবং কন্যা সংঘমিত্রাকে সিংহলে (শ্রীলঙ্কায়) পাঠিয়েছিলেন।
মাসিক অনুশাসনে তিনি ‘রুদ্রাক্ষ’ এবং সারনাথ শিলালিপিতে ‘ধর্মাশোক’ নামে অভিহিত হন। তিনি ‘দেবতাপ্রিয়(দেবতার প্রিয়) এবং সন্তুষ্টিময় চেহারার জন্য ‘প্রিয়দর্শী’ নামে পরিচিত হন।
মৌর্য শাসনের বৈশিষ্ট্য
সারনাথের চার সিংহের মস্তক সহ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রতীক হিসাবে গৃহীত হয়।
রাজকীয় সহায়তায় গুরুকুল এবং বৌদ্ধ মিশনারিগণের উন্নতি বিধান হয়েছিল। এই যুগের অবদান হল তক্ষশীলা এবং বারাণসী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। এই যুগের নামকরা সাহিত্য হল-কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, ভদ্রবাহুর কল্পসূত্র, বৌদ্ধধর্মের পাঠ্যপুস্তক- কথাভট্টু এবং জৈন পাঠ্যপুস্তক যেমন-ভগবতী সূত্র, অচরঙ্গাসূত্র, দাসাবাকলিক প্রভৃতি।
মৌর্যসাম্রাজ্যের পতনের কারণ
অশোকের বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা এবং বলিদান প্রথার বিরুদ্ধাচারণের মনোবৃত্তি ব্রাহ্মণগণের আয়ের ক্ষতিসাধন করেছিল। সে কারণে তাদের অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ভূ-সম্পত্তির উৎস থেকে রাজস্ব আদায় সঠিক পরিমাণ ছিল না এবং বিরাট সাম্রাজ্যের খরচ নির্বাহ করা অসম্ভব ছিল এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শত্রুপক্ষের লুন্ঠিত মালের পরিমাণ কিছুই ছিল না।
অশোকের উত্তরসূরিরা এত দুর্বল ছিল যে বিশাল কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্য একত্রিত করে রাখার ক্ষমতা ছিল না।
বি.দ্র- সৈন্যাধ্যক্ষ পুষ্যমিত্র শুঙ্গ যিনি মগধে শুঙ্গ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁর হাতে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্যবংশের শেষ সম্রাট বৃহদ্রথ নিহত হন।