ধর্মীয় আন্দোলন
সুফিবাদ
সুফি আন্দোলন শুরু হয় প্রথমে আরবের বসরা শহরে রাবেয়ার নেতৃত্বে। গ্রিক, বৌদ্ধ ও উপনিষদের প্রভাবে ইরাক, ইরান ও মিশরে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়।
ভারতে এই আন্দোলন শুরু হয় যথা-চিস্তি, সুহরাবর্দি, সাত্তারা।
চিস্তি সম্প্রদায়- খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি ছিলেন চিস্তি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। মূল কর্মকেন্দ্র ছিল। চিস্তি সম্প্রদায়ের অন্যান্য সন্তরা হলেন-শেখ কুতুবউদ্দিন বক্তিয়ার কাকি, নিজামউদ্দিন আউলিয়া, নাসিরুদ্দিন চিরাগ, সেলিম চিস্তি। এই সম্প্রদায়ের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সন্ত ছিলেন নিজাউদ্দিন আউলিয়া।
সুহরাবর্দি সম্প্রদায়- শেখ শিহাবুদ্দিন সুরাবর্দি এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। ইলতুতমিস বহিউদ্দিন জাকারিয়াকে শেখ-উল-ইসলাম উপাধি দেন। এই সম্প্রদায় দরিদ্র নৈতিকতাকে গুরুত্ব দিত না। শিহাবুদ্দিন সুরাবর্দি ‘আওয়ারিফুল মারিফ’ নামে গ্রন্থ রচনা করেন।
সাত্তারা সম্প্রদায়- এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শাহ আবদুল্লা সাত্তারি। মহম্মদ ঘাউস এই সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রচারক। বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম ও সম্রাট হুমায়ুন এই সম্প্রদায়কে শ্রদ্ধা করেন।
এই ধর্মমতে সর্বধর্ম সমন্বয়, সর্বজীবে প্রেম, ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ, একেশ্বরবাদ, সব কিছুই ঈশ্বরের অঙ্গ প্রভৃতি আদর্শ উচ্চারিত হয়েছে।
‘সুফি’ কথার অর্থ হল পশম। সুফিরা মোটা পশমের বস্ত্র দ্বারা নিজেদের আচ্ছাদিত করে রাখতেন বলে তাদের ‘সুফি’ বলা হত। মতান্তরে সুফি শব্দটি আরবি শাফা অর্থাৎ পবিত্রতা থেকে সুফি ধর্মের উৎপত্তি।
সুফি গুরুকে বলা হয় ‘পির’ বা ‘খাজা’ এবং পিরের কর্মকেন্দ্রকে বলা হয় ‘দরগা’ বা ‘খান্কা’। সুফি ধর্মের অনুগামীদের বলা হয় ‘ফকির’ বা ‘দরবেশ’।
বিখ্যাত কবি আমির খসরু এবং ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনি তার শিষ্য ছিলেন এবং স্বয়ং সুলতান আলাউদ্দিন খলজিও তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
তার উল্লেখযোগ্য শিষ্য হলেন শেখ নাসিরউদ্দিন বা নাসিরউদ্দিন চিরাগ যাকে ‘চিরাগ-ই-দিল্লি’ বা ‘দিল্লি আলো’ বলা হত।
কুতুবউদ্দিন বক্তিয়ার কাকির নামে কুতুবমিনার তৈরি হয়েছিল।
সেলিম চিস্তি-র নাম অনুযায়ী আকবর তার পুত্রের নাম রাখেন সেলাম।
সুহরাবর্দি সম্প্রদায়ের কার্যকলাপ মূলত পাঞ্জাব, মুলতান ও বাংলায় সীমাবদ্ধ ছিল।
শেখ শিহাবুদ্দিন সুহরাবর্দি ও হামিউদ্দিন নাগোরি ছিলেন এই সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট সন্ত।
সুহরাবর্দি সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন আব্দুল হামিদ লাহিড়ী।
সাত্তারা সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন তানসেন। তানসেনের পূর্বনাম রামতনু পান্ডে। ইনি সেতার বাদক ছিলেন।
ভক্তিবাদ
সুলতানি যুগে ভক্তিবাদ নামক একটি উদাহরণ ধর্মদর্শনের উদ্ভব ঘটে। ভক্তিবাদের মূলকথা হল-অন্তরের পবিত্রতা, ঈশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি, সৎকর্ম, সৎ আচরণ, জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ও এক ঈশ্বরের বিশ্বাস। ভক্তি শব্দের অর্থ হল ভজনা, অর্থাৎ একমনে ঈশ্বরের নাম গান করা। প্রথমে দক্ষিণ ভারতে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা হলেও পরে তা উত্তর ভারত ও পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।
শঙ্করাচার্য-
ভক্তি কথাটির উদ্ভাবক ছিলেন শঙ্করাচার্য। তার দর্শনকে অদ্বৈতবাদ বলা হত। তিনি উপনিষদের উপরটি লিখেছিলেন। শঙ্করাচার্য ৪টি মঠ তৈরি করেন-পুরী, দ্বারকা, শিঙ্গীরা ও বদ্রিনাথ। শঙ্করাচার্যকে জগৎ গুরু বলা হয়। তিনি অদ্বৈতবাদের প্রবক্তা। ভক্তিবাদের মূল কথা হল আত্মার সঙ্গে পরআত্মার মিলন। খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে দাক্ষিণাত্যেই প্রকৃতপক্ষে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়। শৈব নায়নার এবং বৈষ্ণব আলওয়ার সম্প্রদায় এই আন্দোলনের সূচনা করেন। এদের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা ছিলেন শিব ও বিষ্ণু। পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে ভক্তিবাদ এক ব্যাপক আন্দোলন রূপ ধারণ করে। ভক্তিবাদের প্রচারকেরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।
রামাজুন-
একাদশ শতকে অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপতিতে জন্মগ্রহণ করলেও কাঞ্চিপুরমে বাস করতেন। তাঁর দর্শন হল বিশিষ্ট দ্বৈতবাদ। তাঁর শিষ্যরা শ্রী বৈষ্ণব, শ্রী সম্প্রদায় ও বেদান্ত দেশিক নামে পরিচিত।
নিম্বার্ক-
ত্রয়োদশ শতকে ভক্তিবাদী প্রচারক ছিলেন। তাঁর দর্শন হল দ্বৈতাদ্বৈত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়ের নাম শঙ্করী সম্প্রদায়। তিনি সিদ্ধান্ত রত্ন ও বেদান্ত পারিজাত সৌরভ নামে দুটি বই রচনা করেন।
সুরদাস (১৪৮৩-১৫৬৩ খ্রিঃ)-
তিনি বল্লভাচার্যের শিষ্য ছিলেন। তিনি কৃষ্ণের বাল্যকালকে নিয়ে গান গাইতেন। তিনি আগ্রা ও মথুরার মন্দিরগুলিতে সংগীতের প্রচলন করেন। তিনি ‘সুরসাগর’, ‘সুরওয়ালি’ গ্রন্থ দুটি রচনা করেন।
তুলসী দাস (১৫৩২-১৬২৩ খ্রিঃ)-
উত্তর ভারতের ভক্তিবাদী আন্দোলনের প্রচারক ছিলেন। তিনি ছিলেন সগুন। তাঁর লিখিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল রামচরিতমানস (আওয়াধি), বিনয় পত্রিকা, ‘গীতওয়ালি’ প্রভৃতি।
ভবানী দাস-
তাঁর লিখিত গ্রন্থ দুটি হল ‘সত্যপ্রকাশ’ ও ‘প্রেমপ্রকাশ’।
জগজীবন দাস-
তিনি সত্যনামী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন।
রামানন্দ (পঞ্চদশ শতক)-
তিনি ছিলেন রামের উপাসক। তিনি ছিলেন নির্গুণ ভক্তি ধর্মের প্রচারক। তাঁর বারোজন শিষ্যকে বলা হত ‘অবধূত’। এই বারোজনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কবীর (তাঁতি), রুইদাস (মুচি) ও পরমানন্দ। তিনি সংস্কৃতের বদলে হিন্দি ভাষাকে ধর্ম প্রচারের বাহন করেন। তিনি বলেন কোনো মানুষের ধরম ও জাত জানতে যেও না।
কবীর (১৪৪০-১৫১৮)-
বারাণসীতে মুসলিম তাঁতি প্রিবারে পালিত কবীর ছিলেন ষোড়শ শ্তকের একজন বিখ্যাত ভক্তি সাধক। তিনি ছিলেন রামানন্দের শিষ্য। দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদীর সময়ে ধর্মমত প্রচার করেন। তাই কবীরের মতে রাম, হরি, আল্লাহ, সাহিব ইত্যাদি ছিল এক ঈশ্বরের বিভিন্ন নাম। কবীরের উপদেশ সংবলিত হিন্দি ভাষায় লেখা ছোটো ছোটো কবিতাগুলি দোঁহা নামে খ্যাত। তাঁর দোঁহাগুলি হিন্দু সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং কবীর পন্থী নামে পরিচিত হন। কবীর পন্থীদের মতে ‘বীজক’ হল পবিত্র গ্রন্থ। এই পবিত্র গ্রন্থে কবীরের বাণী সংকলিত রয়েছে। দোঁহাগুলি আদিগ্রন্থে স্থান পায়।
ভক্তদাদু বা দায়ুদয়াল-
মধ্যযুগের এক খ্যাতনামা সাধক ছিলেন দাদু। তিনি বলতেন “আমি হিন্দু নই, মুসলমান নই; আমি পরম করুণাময় ঈশ্বরকেই ভালোবাসি”। তাঁর কবিতাগুলি ‘বাণি’ নামে পরিচিত।
নামদেব-
মহারাষ্ট্রের ভক্তিধর্মের প্রচারক। তিনি রামের ভক্ত।
তুকারাম-
মারাঠা নায়ক শিবাজীর সম-সাময়িক। তিনি মারাঠা জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত ছিলেন। তিনি ‘বরকবি’ সম্প্রদায় গড়ে তোলেন।
রামদাস-
মহারাষ্ট্রের অন্যতম ভক্তিবাদী প্রচারক। তিনি শিবাজীর গুরু ছিলেন। তিনি বারো বছর ধরে সাধনা করেন। তিনি ‘বলভীম’ সম্প্রদায় গড়ে তোলেন। তিনি ‘আনন্দভুবন’; ‘দাসবোধ; ‘কুরণাশক্তি’ প্রভৃতি গ্রন্থ লেখেন।
মীরাবাঈ-
মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের এক মহিলা প্রচারক ছিলেন মীরাবাঈ। তিনি চিতোরের রানি ছিলেন। তিনি ছিলেন কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর। তিনি রাজপ্রাসাদের মোহ ছেড়ে মথুরা ও বৃন্দাবনে সাধুসঙ্ঘে কালাতিপাত করেন। মোঘল সম্রাট আকবর ভজন সংগীত শুনতেন।
গুরু নানক (১৪৬৯-১৫৩৮ খ্রিঃ)-
শিখ ধর্মের প্রবর্তক ও মধ্যযুগের ভক্তিবাদের অন্যতম প্রচারক ছিলেন গুরু নানক। লাহোর তালবন্দি গ্রামে ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একেশ্বরবাদী ও হিন্দু-মুসলমান ওক্যের উপর জোর দিতেন। তিনি নাম (ঈশ্বর চিন্তা), দান, আস্নান (স্নান), সেবা এবং সিমরান (প্রার্থনা)এই পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দেন। শিখ ধর্মের বাণী ‘গ্রন্থসাহেব’ নামক গ্রন্থে সংকলিত রয়েছে। শিখ শব্দের অর্থ ‘শিষ্য’।
চৈতন্যদেব (১৪৬৮-১৫৩৩ খ্রিঃ)-
পূর্ব ভারতের ভক্তিবাদের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন শ্রীচৈতন্য। আসল নাম ছিল বিশ্বম্ভর মিশ্র। ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জগ্ননাথ মিশ্র ও মাতা শচীদেবী। এগারো বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হয়েছিলেন। এই সময় পণ্ডিত কেশব কাশ্মিরীকে তর্কযুদ্ধে হারিয়ে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। বাইশ বছর বয়সে ঈশ্বরপুরীর কাছে তিনি কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নেন। চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাসী হন। চৈতন্যদেবের গুরুর নাম কেশবভারতী। চৈতন্যদেব ছিলেন ‘বাংলার নব বৈষ্ণব ধর্ম’ বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। তিনি বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ও উড়িষ্যার গজপতি প্রতাপ রুদ্রদেবের সম-সাময়িক ছিলেন। ‘নব বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক চৈতন্যদেবের শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন নিত্যানন্দ, যবন হরিদাস, রূপ গোস্বামী, জীব গোস্বামী, জগাই, মাধাই প্রমুখ। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ই জুলাই আটচল্লিশ বছর বয়সে নীলাচলে (পুরী)চৈতন্যদেব দেহরক্ষা করেন।