গুপ্ত সাম্রাজ্য
গুপ্ত রাজবংশ
কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পর কুষাণ এবং সাতবাহন এই উভয়ের পূর্ববর্তী রাজ্য নিয়ে সাম্রাজ্য প্রিতিষ্ঠিত হয়।
এই রাজবংশের প্রথম দুজন রাজা হলেন শ্রীগুপ্ত এবং ঘটোৎকচ।
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত (৩১৯-৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ)
গুপ্ত বংশের প্রাতকৃতী রাজা হলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত।
৩১৯-৩২০ খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত যুগ শুরু হয়েছিল।
নেপালের লিচ্ছবি রাজবংশের রাজকুমারী কুমার দেবীকে বিবাহ করে তিনি তাঁর রাজ্য পদমর্যাদা বৃদ্দি করেন।
তিনি ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
নিজের দুই নামেই তিনি মুদ্রার প্রচলন করেন। তাঁর রানি এবং লিচ্ছবি রাজবংশ তাঁর বিবাহের স্বীকৃতি প্রদান করে।
সমুদ্রগুপ্ত (৩৩৫-৩৭৫ খ্রিস্টাব্দ)
চন্দ্রগুপ্তের পুত্র এবং উত্তরসূরি সমুদ্রগুপ্তের আমলে গুপ্ত রাজবংশের বিশাল বৃদ্ধি ঘটে। তাঁর সভাকবি হরিসেন সমুদ্রগুপ্তের পৃষ্ঠপোষকতায় সেনাবাহিনীর বৃদ্ধি সমুদ্রগুপ্তের জনসাধারণও দেশজয়ের কথা লিখে গিয়েছেন।
সমুদ্রগুপ্ত যুদ্ধ এবং রাজ্য জয়ের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। এবং তার বীরত্ব ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তাঁকে ঐতিহাসিক ভি. এ. স্মিথ ভারতের নেপোলিয়ান বলে অভিহিত করেছেন।
কথিত আছে সমুদ্রগুপ্ত উচ্চধরণের অসংখ্য কবিতা লিখেছিলেন। তাঁর প্রচলিত মুদ্রায় বীণাবাদনরত সমুদ্রগুপ্তের মূর্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন।
তিনি কবিরাজ এবং বিক্রমাঙ্ক উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
বসুবন্ধু নামে বৌদ্ধ পন্ডিত তাঁর মন্ত্রী ছিলেন।
শ্রীলঙ্কায় শাসক মেঘবর্মনের কাছ থেকে ধর্মপ্রচারের জন্য লোক এবং অনুমতি নিয়ে গয়ায় বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণের মত দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৮০-৪১৩ খ্রিস্টাব্দ)
সমুদ্রগুপ্তের উত্তরসূরি ছিলেন রামগুপ্ত কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয় তাঁকে হত্যা করেন এবং তাঁর রানি ধ্রুবদেবীকে বিবাহ করেন।
নাগাদের সঙ্গে তিনি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন (নাগারা উত্তর ও মধ্য ভারতের অধিবাসী)এবং তিনি রাজকুমার কুবেরঙ্গাকে ভাকটকা পরিবারে দ্বিতীয় রুদ্রসেনের কন্যা প্রভাবতীর সঙ্গে বিবাহ দেন।
উজ্জয়িনির ক্ষত্রিয় রাজা তৃতীয় রুদ্রসেনাকে পরাজিত করে তিনি বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেন। তিনি সিংহ বিক্রম উপাধিও ধারণ করেছিলেন।
তিনিই প্রথম শাসক যিনি রুপার মুদ্রার প্রচলন করেন এবং তামার মুদ্রার প্রচলনও তিনি করেছিলেন। নিউদিল্লির কুতুবমিনারের কাছে লৌহস্তম্ভের উৎকীর্ণ লিপিতে রাজা চন্দ্রগুপ্তের নাম উল্লেখ আছে (অনেক চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কথাই বলা হয়েছে)।
নয়জন রত্ন তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন (নবরত্ন)। নবরত্নের মধ্যে ছিলেন কালিদাস, অমরসিংহ, বরাহমিহির এবং ধন্বন্তরী।
এই সময়ে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ভারতে এসেছিলেন।
প্রথম কুমারগুপ্ত (৪১৩-৪৫৫ খ্রিস্টাব্দ)
প্রথম কুমারগুপ্ত ‘মহেন্দ্রাদিত্য’ খেতাব গ্রহণ করেছিলেন।
প্রাচীন ভারতের প্রসিদ্ধ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন।
দেবাদিদেব শিবের পুত্র কার্তিকেয়-র তিনি উপাসনা করতেন।
তুরস্ক-মোঙ্গল জাতি হূনদের আক্রমণে তাঁর সাম্রাজ্যের শান্তি ও প্রগতি বিঘ্নিত হয়েছিল। হুনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কুমারগুপ্ত নিহত হন।
স্কন্দগুপ্ত (৪৫৫-৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ)
প্রথম কুমারগুপ্তের উত্তরসূরি ছিলেন স্কন্দগুপ্ত। তিনি সাফল্যের সঙ্গে হুনদের মোকাবিলা করেছিলেন।
সুদর্শন হ্রদ তিনি পুনরুদ্ধার করেছিলেন।
তাঁর মৃত্যুর পর গুপ্তযুগ শেষ হয়। সাম্রাজ্য বর্তমান ছিল কিন্তু কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং উত্তরাধিকারী সূত্রে স্থানীয় শাসনকর্তারা মাথা চাড়া দিয়েছিল।
গুপ্তসাম্রাজ্যের পতন
স্কন্দগুপ্তের দুর্বল উত্তরসূরিরা হুনদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে দমন করতে পারেননি। বিহার, বাংলা এবং বল্লভী প্রভৃতি স্থানে জায়গিরদারদের উদ্ভব হয়েছিল।
বি.দ্র- মিহিরকুল ছিলেন বিখ্যাত হুন রাজা। মিহিরকুলকে বৌদ্ধধর্মের হিংস্র নিগ্রহকারী হিসাবে হিউয়েন সাঙ বর্ণনা করেছেন। মালওয়ার গুপ্তবংশের যশোবর্ধন নামে এক জায়গিরদারের হাতে মিহিরকুল নিহত হন।
গুপ্ত শাসনকর্তাদের অবদান
শাসনব্যবস্থা
রাজাদের বলা হত পরমেশ্বর, মহারাজাধিরাজ বা পরমভট্টারক।
সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রাজকর্মচারীগণ ছিল কুমারামাত্য।
সেনাবাহিনীর সংগঠন ছিল সামন্ততান্ত্রিক বা জায়গিরদার ভিত্তিক যদিও সম্রাটের মজুত সেনাবাহিনী ছিল প্রাচীন। ভারতে তারা স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিল। এগুলিকে বলা হত দিনারা, রৌপ্য মুদ্রাগুলিকে বলা হত রুপায়কা।
সামাজিক উন্নয়ন
জাতিশ্রেণি কয়েকটি উপজাতি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল।
ভিস্তি অর্থাৎ বলপূর্বক শ্রমিক প্রথা চালু ছিল।
স্ত্রীলোকদের অংশগ্রহণ প্রথা অস্বীকার করা হয়েছিল।
মধ্যপ্রদেশের ইরানে সতীদাহ প্রথা প্রচলন হল এর প্রথম উদাহরণ।
শূদ্রদের অবস্থা বাস্তবিকভাবে উন্নত হয়েছিল।
অস্পৃশ্য প্রথা চালু ছিল বিশেষত চন্ডালদের ঘৃণা করা হত।
ফা-হিয়েনের বিবরণে জানা যায় যে চন্ডালেরা গ্রামের বাইরে বাস করত এবং উচ্চশ্রেণি জাতির কাছ থেকে দূরে থাকত।
কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জন্য নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত।
ধর্ম
এই সময়কালের ভাগবদগীতা লেখা হয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম অস্বীকৃত হয়েছিল।
ভাগবদধর্মের মাধ্যমে বিষ্ণু বা ভাগবদ পূজা চারিদিকে শুরু হয়েছিল।
ইতিহাসে বিষ্ণুর দশ অবতার চক্রের কথা বলা হয়েছে।
পুতুল পূজা এক সাধারণ বিষয়রূপে উপস্থাপিত হয়েছিল।
গুপ্তযুগে স্থাপত্যের নিদর্শন হল ঝাঁসির নিকট দেওঘরে বিষ্ণুমন্দির, সাঁচির নিকট ছোটো মন্দির এবং কানপুরের নিকট ভিত্রাগাঁওয়ে ইটের তৈরি মন্দির নির্মাণ।
শিল্পকলা
সমুদ্রগুপ্ত তার বীণাবাদনরত মূর্তি মুদ্রায় উপস্থাপিত করেছিলেন। মথুরা বিদ্যালয়ে দু মিটার উচ্চ ব্রোঞ্জের তৈরি বুদ্ধমূর্তি, গোলধারবুদ্ধ শৈত্যের মুখোশ পড়া বুদ্ধমূর্তি উপস্থাপন করেছিল যখন মথুরা বিদ্যালয় থেকে বুদ্ধকে উষ্ণতা ও জীবনীশক্তির প্রতীক হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল। সারনাথে বুদ্ধদেব ধর্মচক্রের উপর উপবিষ্ট আছেন এমন মূর্তি নির্মাণ। গুপ্তযুগে ব্যমিয়ানদের বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ।
এই সময়কালে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রের নিকট বাঘ-এ এবং অজন্তায় চিত্রাঙ্কন তৈরি।
এই সময়কালে বিষ্ণু, শিব এবং অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির উপস্থাপনা হয়েছিল।
সাহিত্য
এই সমকালের মহান সংস্কৃত ভাষার নাট্যকার হলেন মহাকবি কালিদাস। তাঁর গ্রন্থগুলি হল অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ (বিশ্বে অন্যতম এক সাহিত্যিক বলে বিবেচিত এবং অন্যতম ভারতীয় সাহিত্য যা ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত এবং অন্যান্য সাহিত্য ভাগবতগীতা অবলম্বনে লিখিত), অন্যান্য গ্রন্থ হল ঋতুসংহার, মেঘদূতম, কুমারসম্ভবম, মালবিকাগ্নিমিত্রম, রঘুবংশ-এগুলি মহাকাব্য ও নাটক। ভারতীয় (কিরা ও অর্জুনীয়)কালিদাস ব্যতীত শূদ্রক (মৃচ্ছকটিকম্ এর লেখক)দানদীন কাব্যদর্শন, এবং দশকুমার চরিত এই সময়ের চরিত্র। এই সময়ে ভাস কর্তৃক ১৩ খানি নাটক লিখিত হয়েছিল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-চারুদত্ত।
বিশাখাদত্ত লিখিত মুদ্রারাক্ষস এবং দেবীচন্দ্রগুপ্তম্।
বিষ্ণুশর্মা লিখিত পঞ্চতন্ত্র এবং হিতোপদেশ।
গুপ্তযুগেই লিখিত হয়েছে পানিনি ও পতঞ্জলির উন্নত ধরণের সংস্কৃত ব্যাকরণ। এই সময়কালেই অমর সিংহ কর্তৃক সংকলিত অমরকোশ প্রকাশিত হয়েছে।
চতুর্থ খ্রিস্টাব্দে প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে রামায়ণ ও মহাভারত লেখা।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
অঙ্কশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে অবিসংবাদিত কৃতিত্ব গুপ্তযুগেই ঘটেছিল। মহান গণিতবিদ আর্যভট্ট লিখেছিলেন আর্যভট্টীয় এবং সূর্যসিদ্ধান্ত। আর্যভট্টীয়তে তিনি প্রথম নয়টি সংখ্যা এবং শূন্য-র স্থানীয় মান-এর বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি পাই-এর মান-এর গণনা করেছেন এবং বীজগণিতের মান নির্ণয় করেছেন। তিনিই প্রমাণ করেন যে পৃথিবী তার মেরুদন্ডের উপর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। এই ভাবে তিনি আবিষ্কার করেন সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ এবং গ্রহণ ঘটায় সময়ের হিসাব তিনিই করেন। তিনি আরও বলেন যে সৌরজগতে চাঁদের মতো গ্রহ এবং আলোর প্রতিফলনে তারা আলোকিত হয়।
বরাহমিহির লিখেছিলেন পঞ্চসিদ্ধান্তিকা এবং বৃহৎসংহিতা। তিনি বলেছিলেন যে চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে এবং পৃথিবী ও চাঁদ উভয়েই সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। ব্রহ্মগুপ্তও ছিলেন এক মহান গণিতবিদ। তিনি ব্রহ্মস্ফটিক সিদ্ধান্ত লিখেছিলেন এবং এর মধ্যেই তিনি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আভাস দিয়েছিলেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়ে রোমাকাসিদ্ধান্ত সংকলিত হয়েছিল।
আয়ুর্বেদিক ভেষজ ক্ষেত্রে বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন ভগভট্ট।
পালাকাপিয়া লিখেছিলেন হাতির অসুখের চিকিৎসার জন্য হস্তীয়গর্বেদ।
রাজ ভাষা ছিল সংস্কৃত।
আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ ছিলেন ধন্বন্তরী।