সিপাহি বিদ্রোহ ১৮৫৭
কারনসমূহ
রাজনৈতিক কারণ-
নানা সাহেবকে মাসিক সরকারি অর্থ সাহায্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তিনি বাহিরাও II দত্তক পুত্র ছিলেন।
ত্রুটি-বিচ্যুতির তত্ত্ব বা ডকট্রিন অফ ল্যাপসের প্রয়োগ।
অর্থনীতি সংক্রান্ত-
প্রচণ্ড করের বোঝা, আইনবলে উৎখাত, অনৈতিক শুল্ক চাপানো ভারতীয় দ্রব্যের উপর এবং ভারতীয় ঐতিহ্যবাদী নানারকম হাতের কাজকে ধ্বংস করা। এইসব কাজ সমস্ত ভারতীয় চাষিদের, শিল্পীদের এবং ছোটো জমিদারদের প্রচন্ড আঘাত করেছিল।
সামরিক বৈষম্য-
ভারতীয় সৈনিকদের কম বেতন দেওয়া হত, তারা সুবেদার পদের ঊর্ধ্বে উঠতে পারতেন না এবং তারা বর্ণবৈষম্যের শিকার হতেন।
তাদের সুদূর পাঞ্জাব এবং সিন্ধ অঞ্চলে লড়াই করবার জন্য কোনো বাট্টা (ভাতা) দেওয়া হত না।
ধর্মীয় বৈষম্য-
ব্রিটিশ দ্বারা কৃত সামাজিক পরিবর্তন যেমন বিধবা বিবাহ, সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ, কন্যাদের শিক্ষাপ্রাপ্তি এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা ধর্মান্তকরণ।
এনফিল্ড রাইফেলের আনয়ন এবং রাইফেলের কার্তুজে পশুচর্বি ব্যবহৃত গ্রিজের ব্যবহার।
রেলওয়েজ এবং টেলিগ্রাফের অগ্রগতি এবং পশ্চিমী শিক্ষার প্রসার।
যুদ্ধের প্রাদুর্ভাব-
মার্চ 29, 1857 সালে 19তম এবং 34তম জাতীয় পদাতিক বাহিনীর সৈনিক মঙ্গল পান্ডে তাঁর এক উচ্চপদের অফিসারকে আক্রমণ করে এবং গুলি চালিয়ে দেয়। ঘটনাটি বাংলার ব্যারাকপুরে ঘটে।
10ই মে মিরাটে তৃতীয় জাতীয় অশ্বারোহী সিপাইগণ বিদ্রোহ শুরু করে।
বিদ্রোহ সারা উত্তরপ্রদেশে ছ্রিয়ে পড়ে এবং অন্য রাজ্যেও এর প্রভাব পড়ে।
বিদ্রোহীদের এক্টাই শ্লোগান ‘দিল্লি চলো’ সারা ভারতকে উত্তাল করে তোলে।
দিল্লিতে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট ঘোষনা করা হয়।
যে অঞ্চলের শাসকরা ব্রিটিশের গোলামি করত, তাদের সৈনিকরাও বিদ্রোহ করতে শুরু করল যেমন গোয়ালিয়র, ইন্দোর প্রভৃতি। কোনো কোনো অঞ্চলে সিপাইদের পূর্বে সাধারণ মানুষরাও বিদ্রোহে শামিল হয়।
প্রথমে বিদ্রোহ সফল হয়। ইউরোপীয়দের হত্যা করা হয়, কাছারি এবং পুলিশ চৌকি আক্রমণ হয়, কর-শুল্ক সংক্রান্ত দস্তাবেজ ধ্বংস করা হয়। কিন্তু পালটা আক্রমণের সূচনা হতে আরম্ভ করে।
প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ-
বখত খান দিল্লি বাজেয়াপ্ত ক্রেহচিলেন। তিনি বেরিলি ইউনিটের সৈনিক ছিলেন।
নানা সাহিব ওরফে ধোন্ধু পন্থ কানপুর ইউনিটের সৈনিক ছিলেন, তাঁর সহযোগী ছিলেন তাঁতিয়া টোপি এবং আজিমুল্লাহ। বেগম হজরত মহল অবোধের রানি ছিলেন। তিনি তাঁর পুত্রকে অবোধের নবাব ঘোষণা করেছিলেন।
রানি লক্ষ্মীবাঈ, ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাওয়ের বিধবা পত্নী। তাঁতিয়া টোপী সহযোগে গোয়ালিয়রে সিন্ধিয়া শাসকদের পরাস্ত করেন। কিন্তু তাঁরা দুজনেই স্যার হাগ রোজ-এর দ্বারা পরাস্ত হন। লক্ষ্মীবাঈ 17ই জুন, 1858 সালে মারা যান, তাঁতিয়া টোপিকে নির্বাসিত করা হয়।
কুনওয়ার সিং এবং অমর সিং বিহারের দুজন বিখ্যাত বিপ্লবী ছিলেন।
দেবী সিং মথুরার একজন বিপ্লবী।
কদম সিং মিরাটের একজন বিপ্লবী।
প্রভাবশালী ব্রিটিশ ব্যক্তিত্ব যাঁরা বিদ্রোহকে দমন করেছিলেন-
দিল্লিতে জন নিকোলসন এবং হাডসন।
কানপুরে কানপুরে ক্যাম্পবেল এবং হ্যাভলক।
লখনউতে হ্যাভলক, আউটরাম, জেমস নিল এবং ক্যাম্পবেল।
ঝাঁসিতে হাগ রোজ।
বেনারসে জেমস নিল।
বিদ্রোহ পাকাপাকিভাবে দমিত হয় 1858 খ্রিস্টাব্দে।
বিদ্রোহী নেতাদের নিয়তি-
দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে অন্তরীণ করা হয় যেখানে 1862 সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁহার পুত্রদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
নানা সাহিব এবং বেগম হজরত মহল নেপালে পালিয়ে যান।
ঝাঁসির রাই লক্ষ্মীবাঈ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেন।
তাঁতিয়া টোপিকে 1859 সালে নির্বাসন দেওয়া হয়।
বিদ্রোহ অসফল হবার কারণ
গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়াগণ, ইন্দোরের হোলকারগণ, হায়দ্রাবাদের নিজাম, যোধপুরের রাজা, ভোপালের নবাব, পাতিয়ালার সিন্ধ এবং কাশ্মীরের শাসক সমূহ এবং নেপালের রানা বিদ্রোহের চরম বিরোধিতা করে ব্রিটিশদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
বিদ্রোহীদের সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নিম্নমানের ছিল।
নেতৃত্বে ঘাটতি ছিল।
আধুনিক নেতৃবৃন্দ এই বিদ্রোহের কারণকে সমর্থন করেননি।
বিদ্রোহের ফল
এই বিদ্রোহ মূলত সামন্ততান্ত্রিক ধাঁচের ছিল যা কিছু জাতীয়তাবাদীকে ছিনিয়ে নেয়।
ভারতীয় প্রশাসন পুরোপুরিভাবে ব্রিটিশদের হাতে চলে যায় গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট, 1858 সুবাদে। ব্রিটিশ সৈন্যে রদবদল হয় এই বিদ্রোহের পুনরুত্থানকে আটকাতে।
ঝাঁসীর রানি লক্ষ্মীবাঈ
লক্ষ্মীবাঈ ছিলেন ভারতে ব্রিটিশ প্রতিরোধ আন্দোলনের এক মূর্ত প্রতীক। তিনি তাঁর রাজ্যে মানু নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি 1828 খ্রিঃ বারানসীর মনিকারনিকটম্বেতে জন্মে ছিলেন, এবং ঝাঁসীর রাজা গঙ্গাধর রাওকে বিবাহ করেছিলেন 1842 সালে। তিনি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন 1851 সালে। কিন্তু চার মাস বয়সেই সন্তানটি মারা যায়। 1853 সালে গঙ্গাধর চরম অসুস্থ হন এবং মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি একটি পালিত পুত্র নিতে বাধ্য হন। লর্ড ডালহৌসী ডকট্রিন অফ ল্যাপসের সুবাদে ঝাঁসী অধিকার করতে মনস্থ করেন কিন্তু রানি ঝাঁসীকে রক্ষা করতে নিজে সৈন্যদল সমেত রুখে দাঁড়ান। এই সময় তিনি ইংরেজ মিত্র সিন্ধিয়াদের পরাস্ত করেন এবং গোয়ালিয়র দখল করেন। তিনি ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে পরাস্ত হন এবং কল্পি নামক স্থানে 18 জন 1858 সালে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেন। তার অদম্য মনোভাব, সাহস ও দৃঢ় সংকল্পের জন্য ভারতীয় জাতিয়তাবাদী আন্দোলনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বলে ধরা হয়।
বিদ্রোহের জাতীয় চরিত্র পক্ষে এবং বিপক্ষে
বিপক্ষে-
ঐক্যবদ্ধ ভারত বলে রাজনৈতিক ভিত্তিতে তখন কিছুই ছিল না।
বিদ্রোহী সৈন্য প্রধানত বেঙ্গল আর্মি এবং উত্তর-মধ্যাঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল যদিও বেঙ্গল আর্মিই মুখ্য সৈন্যদল ছিল ভারতের।
বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল ভারতের চেন্নাই, মুম্বাই আর্মি এবং শিখ রেজিমেন্ট দ্বারা।
অনেক মহারাজা এবং যুবরাজেরা এই বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করেননি, যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা প্রকৃতপক্ষে তাঁদের ব্যক্তিগত রাজ্য এবং স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাঁরা কেউই ভারতকে একই সূত্রে বাঁধবার প্রয়াস করেননি।
যে সৈন্য এবং যুবরাজেরা প্রধান বিদ্রোহের হোতা ছিলেন তাঁরা কেউই 1880 জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশ নেননি।
পক্ষে-
যদিও বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল যেমন সিপাইদের বেতন বা পদ সংক্রান্ত চাহিদা, ব্রিটিশদের দমিয়ে রাখার প্রচেষ্ঠা, ডকট্রিন অফ ল্যাপসের প্রয়োগ ইত্যাদি। তবুও বেশিরভাগ বিদ্রোহী মুঘল রাজত্বের পুনরুত্থানের জন্য সচেষ্ট ছিলেন, যেটি জাতীয়তাবাদ প্রতীক রূপে চিহ্নিত হয়।
বিদ্রোহ ছড়িয়েছিল বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন অযোধ্যা, বুন্দেলখন্ড এবং রহিলখন্ডে। সুতরাং বিদ্রোহ কেবল সিপাই বিদ্রোহ একথা বলা যায় না বরং এটা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে প্রসার করেছিল।
সিপাইরা কোনো ছোটো রাজ্যের পুনরাধিকার চায়নি, প্রকারান্তরে তারা সর্ব্বদা চেয়েছিল সর্বভারত শাসন মুঘলদের দ্বারা এবং শপথ নিয়েছিল ব্রিটিশকে ভারত থেকে বিতাড়ন করার। সুতরাং শুধু নিজ রাজ্য নয় পরন্তু সমগ্র ভারতের জন্য এই ঘোষণা প্রমাণ করে জাতীয়তাবাদী চরিত্র।
সংক্ষেপে বলা যায়, দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ যদি সিপাই বিদ্রোহের মতো ছোটো ছোটো আঞ্চলিক যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে এটাকে কোনোভাবেই ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রাম বলা যায় না।
যদি দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ভৌগোলিকভাবে কোনো কোনো অঞ্চলে হয় এবং যদি ওই যুদ্ধের প্রয়াস হয় বিদেশিদের পুরোপুরিভাবে দেশ থেকে বিতাড়ন তাহলে সেটি স্বাধীনতার সংগ্রাম রূপে ধরে নেওয়া যায়।