হরপ্পার গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ (Important Harappan Sites)
*. হরপ্পাঃ
এইঅঞ্চল খনন করে বিশেষ বিশেষ যে স্থানগুলি পাওয়া গিয়েছে সেগুলি হল-
(ক) দুই সারিতে ছয়টি করে ইট দিয়ে বাঁধানো শস্য সংরক্ষণের স্থান। এই বারোটি স্থান মহেন-জো-দারোতে পাওয়া বিরাট শস্যাগারের সমান।
(খ) কফিন-এর সাহায্যে সমাধিক্ষেত্রে কবরস্থ করা হত।
(গ) এক কক্ষ বিশিষ্ট রক্ষী নিবাস।
(ঘ) মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে সরাসরি ব্যাবসা-বাণিজ্যের আদান-প্রদান।
(ঙ) লাল বেলে পাথরের তৈরি মস্তকহীন পুরুষের মূর্তি।
(চ) পাথরের মধ্যে স্ত্রী জননেন্দ্রীয়-এর চিহ্ন।
*. মহেন-জো-দারোঃ
মহেন-জো-দারোর মাটি খুঁড়ে পাওয়া নিদর্শনগুলি হল-
(ক) মহাবিদ্যালয়, বহুস্তম্ভ বিশিষ্ট জনসাধারণের জন্য হল ঘর।
(খ) বিরাটাকার স্নানাগার, এটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সাধারণের জন্য ব্যবহৃত স্নানাগার।
(গ) এখানকার সর্ববৃহৎ শস্যাগার।
(ঘ) বস্ত্র বয়নের টাকু, সূঁচ প্রভৃতি।
(ঙ) অস্পষ্ট ঘোড়ার নিদর্শন।
(চ) পাথরের তৈরি মেসোপটেমিয়ার পাত্র।
(ছ) মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে সরাসরি ব্যাবসা-বাণিজ্যের আদানপ্রদান।
(জ) ব্রোঞ্জের তৈরি নৃত্যরতা বালিকার মূর্তি।
(ঝ) কিছু অধিবাসীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হিসাবে স্তূপাকৃত কঙ্কাল আবিষ্কার।
(ঞ) দেবী জঠরে বর্ধিত চারাগাছ-এর চিহ্ন সহ সিলমোহর এবং পুরুষের হাতে ছুরি সহ স্ত্রী লোককে হত্যা করার দৃশ্য সহ সিলমোহর।
(ট) গোঁফ দাড়ি বিশিষ্ট পুরুষ মূর্তি।
(ঠ) পশুপতি শিবের ছবি সহ সিলমোহর।
*. কালিবঙ্গানঃ
কালিবঙ্গান হল হরপ্পার একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। ‘কালিবঙ্গান’ শব্দটির অর্থ হল কালো বালা। প্রথমদিকে খনন কাজ চালিয়ে চাষ দেওয়া কৃষিতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। খনন কাজ চালিয়ে নীচের নিদর্শন গুলি পাওয়া গিয়েছে।
(ক) কাঠের তৈরি লাঙলের ফাল।
(খ) সাতটি অগ্নিবেদির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যা ধর্মীয় বলিদানের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত।
(গ) ইটের পাঁচিল দিয়ে দুর্গগুলি এবং শহরের উঁচুনীচু অঞ্চলগুলি ঘেরা ছিল।
(ঘ) উটের হাড়-এর নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।
(ঙ) সুসজ্জিত টালি বেষ্টিত বৃত্তাকার স্থানের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
(চ) লম্বা ডিম্বাকার চোখ, মোটা ঠোঁট, চওড়া কপাল এবং দীর্ঘ সূঁচালো নাক বিশিষ্ট মানুষের মাথার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
(ছ) দিউ ধরণের সমাধিক্ষেত্র ছিল। যেমন-বৃত্তাকার ও ত্রিভূজাকার সমাধিক্ষেত্র।
*. লোথালঃ
হরপ্পা সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হল লোথাল। এই শহরটির পরিকল্পনা হরপ্পা ও মহেন-জো-দারো থেকে পৃথক ধরণের ছিল। ছয়টি ভাগে এই শহরটিকে ভাগ করা হয়েছিল। কাঁচা ইঁট দিয়ে এই ভাগগুলিকে ভাগ করা ছিল। ১২ ফুট চওড়া ২০ ফুট লম্বা রাস্তা দিয়ে পৃথক করা ছিল। খননকাজের ফলে আরও কিছু নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। যেমন-
(ক) আমেদাবাদের কাছে রংপুরে ধানের তুষ এর নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।
(খ) কৃত্রিম নৌবন্দরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
(গ) মাটির টেরাকোটা কাজের ঘোড়ার মূর্তির সন্ধান মিলেছে।
(ঘ) কাপড়ের উপর সিলমোহরের ছাপ পাওয়া গিয়েছে।
(ঙ) মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে সরাসরি ব্যাবসা-বাণিজ্যের আদানপ্রদান-এর প্রচলন ছিল।
(চ) বাড়িতে প্রবেশ করার দরজা প্রধান রাস্তার দিকে মুখ করা ছিল।
(ছ) সিলমোহরে জলজাহাজের ছাপের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।
(জ) টেরাকোটা কাজে জলজাহাজের ছাপের নিদর্শন ছিল।
(ঝ) পঞ্চতন্ত্রে বর্ণিত ধূর্ত খেঁকশিয়ালের ছবি পাত্রের উপর আঁকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।
(ঞ) একই সমাধির মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রীলোকের দেহের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
(ট) দাবা খেলার প্রচলনের নিদর্শন মিলেছে।
(ঠ) ৪৫°, ৯০° ও ১৮০° কোণ পরিমাপের যন্ত্র-এর সন্ধানও এখানে পাওয়া গিয়েছে।
*. চানহুদড়োঃ
এই অঞ্চল খনন করে তিন রকম সংস্কৃতির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এই তিনটি সংস্কৃতি হল সিন্ধু সংস্কৃতি, ঝুকার সংস্কৃতি এবং ঝংকার সংস্কৃতি। এই অঞ্চলগুলিতে হরপ্পার বিভিন্ন রকমের কারখানার অবস্থিতি ছিল। এখানে সিলমোহর, খেলনা এবং হাড়ের তৈরি সামগ্রী তৈরি হত। এই অঞ্চলে কোনো দুর্গ ছিল না। ব্রোঞ্জের মূর্তি, গোরুর গাড়ি, এক্কা গাড়ি, ছোটো পাত্র, হাতির পায়ের ছাপ এবং একটা কুকুর বিড়ালকে তাড়া করছে এরকম ছবির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
*. আলমগিরপুরঃ
সিন্ধু সংস্কৃতির পূর্বদিকের সীমায় আলমগিরপুর অবস্থিত। হরপ্পার অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই অঞ্চলেও বিক্রয়যোগ্য পণ্যদ্রব্যের সন্ধান মিলেছে আবার অনেকে বলেছেন হরপ্পা সংস্কৃতির পরবর্তীকালে এই অঞ্চলের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। কাপড়ের উপর আঁকা ঢাকনা বিহীন লম্বা সরু পাত্রের নিদর্শন এখানে পাওয়া গিয়েছে।
*. কোডজিঃ
কোবডজি প্রাক হরপ্পীয় স্থান হিসাবে পরিচিত। প্রাক হরপ্পীয় যুগের বাজেয়াপ্তযোগ্য উপনিবেশ হিসাবে ধারণা দেয়। এখানকার বাড়িঘরগুলি ছিল পাথরের তৈরি। কোডজির অস্তিত্ব ছিল তৃতীয় সহস্র খ্রিস্টপূর্বের প্রথম দিকে। খনন করে জানা গিয়েছে যে-কোনো যুদ্ধ বিগেহের ফলে এই শহরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
*. আমরিঃ
আমরিও প্রাক হরপ্পীয় উপনিবেশ হিসাবে পরিচিত। এই সময়ে দুর্গ নির্মাণ-এর অভাব লক্ষিত হয়েছে। আমরির বিশেষত্ব হল যে প্রাক হরপ্পীয় ও পরবর্তী হরপ্পীয় সভ্যতার মধ্যে যুগ পরিবর্তনের কাল। এই সময়কালে গণ্ডারের উপস্থিতি, ঝংকারের সংস্কৃতির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
*. রোপারঃ
রোপার অঞ্চলেই প্রাক হরপ্পীয় এবং তৎকালীন হরপ্পার সংস্কৃতির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। মাটি এবং পাথর এখানকার বাড়িঘরগুলি প্রধানত তৈরি হত। এখানকার উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারগুলি হল-বাসনপত্র, গয়নাপত্র, তামার কুঠার, টাডা ফলা, মাটির তৈরি টেরাকোটা ফলা, সিলমোহর, বিশেষ ধরণের চিত্র, ডিম্বাকৃতি গর্তের মধ্যে সমাধিক্ষেত্র এবং ত্রিভুজাকৃতি কাঁচা ইটের তৈরি কক্ষ বিশেষ। এখানে মানুষের সমাধির সঙ্গে একটি কুকুরের সমাধিও দেওয়া হত। এটা অবশ্য কাশ্মীরের বার্জহোম অঞ্চলে প্রচলন ছিল, হরপ্পার অন্যান্য অঞ্চলে এর সেরকম প্রচলন ছিল না।
*. বানওয়ালিঃ
হরিয়ানার হিসার জেলায় বানওয়ালি অবস্থিত, খননকাজের পর এখানে দুই-রকমের সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। প্রথমটি হল প্রাক হরপ্পীয় এবং পরবর্তী সভ্যতা। যদিও দ্বিতীয় পর্যায় হরপ্পা সভ্যতায় দাবা খেলার বোর্ড, শহরের ঝাঁঝরি প্রথার প্রচলন সব জায়গায় দেখা যায় নি। রাস্তাগুলি সবসময় সোজাসুজি ছিল না এবং এগুলি সমকোণ অবস্থায় বিভক্ত ছিল না। এখানকার বিশেষত্ব হল সুশৃঙ্খল নিকাশি ব্যবস্থা। খনন করার সময় উচ্চ ধরণের শস্য যব-এর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। অন্য উল্লেখযোগ্য যেসব বস্তু এখানে পাওয়া গিয়েছে সেগুলি হল-সিরামিক শিল্প, সিলমোহর এবং সিন্ধু লিপির বিশেষ ধরণের সিলমোহর।
*. সুরকোতদাঃ
গুজরাটের কচ্ছ অর্থাৎ ভুজ জেলায় সুরকোটাডা অবস্থিত। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে জে. পি. যোশি এই অঞ্চল খনন করে আবিষ্কার করেন। সারকোডাটা হল হরপ্পা অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ। এই অঞ্চলটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হল এখানেই প্রথম ঘোড়ার হাড়-এর সন্ধান পাওয়া যায়। একটি সমাধিক্ষেত্রে চারটি পাত্রসহ বেশ কিছু মানুষের হাড়-এর সন্ধান মিলেছে। এখানে বিরাটাকার পাথরখন্ডের মধ্যে সমাধির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যা তখনকার দিনে বিরল ছিল।
*. সাতকাজেন্দরঃ
এই অঞ্চলটি বর্তমান পাকিস্থানের অন্তর্গত সিন্ধু অঞ্চলে অবস্থিত। এই শহর সিন্ধু সভ্যতার যুগে এক উপকূলবর্তী শহর। এখানে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট শহর পরিকল্পনার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। একটি হল দুর্গ প্রধান এবং অপরটি হল নিম্নস্তর শহর। ক্তহিত আছে যে অঞ্চলটি আসলে একটি বন্দর ছিল। উপকূলীয় উন্নতির প্রভাবে এই অঞ্চলটি শহর-এ পরিণত হয়।
যুগের অবসান
*. প্রায় একহাজার বছর হরপ্পা সভ্যতা টিকে ছিল।
*. আর্যদের আগমন, উপর্যুপরি বন্যা, হরপ্পাবাসীগণের সামাজিক অবস্থার ভাঙন, ভূমিকম্প প্রভৃতিই হল হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের কারণ।