খলজি বংশ
খলজি রাজবংশ
খলজি রাজবংশ আবির্ভাবের ফলে তুরস্ক রাজন্যবর্গের একছত্র শক্তি এবং একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটে।
জালালুদ্দিন ফিরোজ খলজি (১২৯০-১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ)
জালালুদ্দিন হলেন প্রথম শাসক যিনি ভারতে বেশিরভাগ হিন্দু জনসাধারণের উন্নতি বিধান করেছিলেন, যা পুরোপুরি ইসলাম রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। তাঁর রাজত্বকালের প্রধান ঘটনা হল যে ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ভাইপো এবং জামাতা আলি গুরসাপ বা আলা-উদ-দিন খলজির দেবগিরি আক্রমণ। দেভগিরি ছিল দাক্ষিণাত্যে যাদব সাম্প্রদায়ের রাজধানী এবং আলা-উদ-দিন বিশাল কোষাগার লুন্ঠন করেছিলেন।
চেঙ্গিস খানের বংশধর উলুগুলানের সঙ্গে তাঁর কন্যার বিবাহ দিয়ে তাদের শুভেচ্ছা লাভ করেছিলেন।
আলা-উদ-দিন খলজি (১২৯৬-১৩১৫ খ্রিস্টাব্দ)
আলা-উদ-দিন খলজি কাকাকে হত্যা করে নিজেকে সুলতান বলে দাবি করেন এবং দেবগিরি থেকে সংগৃহীত সোনা দানা তাঁর পক্ষের গণ্যমান্য ব্যক্তি বর্গকে ও সৈন্যদের মধ্যে দান করে তিনি তাদের ম্ন জয় করেন।
ক্ষমতায় আসার পর পুরাতন সলবনি এবং জালালি বংশের গণ্যমান্যদের এবং মোঙ্গলদের যারা দিল্লিতে স্থায়ী হয়েছিল এবং নিজ পরিবারের বেশ কয়েকজনকে তাদের বেপোরোয়া ভাবে হত্যা করেন। তিনি প্রথম গুজরাট জয় করেন। গুজরাট তখন বাঘেলা রাজা রাই করণদেব দ্বিতীয় শাসন করতেন। এই জয় দুটি কারণে মনে রাখার মতো-প্রথমত তিনি রাজার মহিষী কমলাদেবীকে বিবাহ করেন, দ্বিতীয়ত মালিক কাফুর নামে এক খোজাকে লাভ করেন যিনি পরবর্তীকালে নামকরা সেনাপ্রধান হয়েছিলেন।
তারপর তিনি রণথম্বর, চিতোর এবং মালওয়া জয় করেন। চিতোরের শাসনকর্তা ছিলেন গেহলট রাজা রত্ন সিং, যাঁর মহিষী পদ্মিনী জহর ব্রত অবলম্বনে দেহত্যাগ করেন স্বামী পরাজিত হওয়ায়। আলাউদ্দিন তাঁর পুত্রের নামে চিতোরের নামকরণ করলেন খিজিরাবাদ।
উত্তর ভারত জয় করার পর মালিক কাফুরাকে দক্ষিণ ভারত জয়ের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। মালিক কাফুর দেবগিরির যাদব রাজা রামচন্দ্র দেবকে, ওয়ারঙ্গলের কাকতীয় রাজা রুদ্রপ্রতাপদেব প্রথমকে, দর্শমুদ্রার হোসল রাজা বীর বল্লার তৃতীয়কে এবং মাদুরাই এর পান্ড্যরাজ্য মরবর্মন ফুলশেখরকে পরাজিত করেন। তিনি রামেশ্বরমের নিকট পৌঁছে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এইভাবে সমগ্র দক্ষিণ ভারত তিনি আলাউদ্দিনের সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
বিশস্ত সৈন্যাধ্যক্ষ গাজি মালিকের নেতৃত্বে উত্তর-পশ্চিমে সীমান্ত অঞ্চল শক্তিশালী করেন। মোঙ্গল আক্রমণকে প্রতিরোধ করার জন্য তিনি লৌহ কঠিন নীতি গ্রহণ করেন। কুতুব মিনারের দরজা সংযুক্ত করেন যার নাম আলাই দরওয়াজা এবং সিরি-তে রাজধানী নির্মাণ করেন।
তিনি দিল্লিতে হাউজ খাস, মহল হাজার সাতুন এবং জামাইত খানা মসজিদ নির্মাণ করেন।
তিনি সিকান্দার-ই-সানি উপাধি গ্রহণ করেন।
মালিক কাবুর
মালিক কাবুর একজন ভারতীয় খোজা যিনি আলাউদ্দিন খলজির সৈন্যদলের সৈন্যাধ্যক্ষ হয়েছিলেন। ১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে এক হাজার দিনারে নসরত খান তাঁকে ক্রয় করেন। এই কারণে তাঁকে হাজার দিনারিও বলা হত। কথিত আছে যে আলাউদ্দিন তাঁর সুদর্শন চেহারায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে সম্মত হওয়ায় সেনাবাহিনীতে কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ করেন। আলাউদ্দিনের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠায় তিনি অতি দ্রূত সেনাবাহিনীতে উচ্চপদ লাভ করেন। তিনি দেবগিরির যাদব রাজ, কাকতীয় রাজ্য, দক্ষিণ ভারত জয়ে তিনি সুলতানের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। কাফুরের দক্ষিণ ভারতের পাণ্ড্য রাজ্য জয় দক্ষিণ ভারতে মুসলিম রাজ্য বিস্তারলাভ করে। কাফুরের দক্ষিণ ভারত জয়ের ফলে আলাউদ্দিন তাঁর হাতের পুতুল হয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন সুলতানের কুচক্রী এক রত্ন এবং ফলে সুলতানের বেগম এবং পুত্রেরা ষড়যন্ত্র করতে থাকে এবং পরিশেষে তাদের বন্দি করা হয়। সিংহাসনের দাবিদার সম্রাটের সম্ভ্রান্ত বংশধরদের অভিযুক্ত করার জন্য দায়ী ছিলেন কাফুর স্বয়ং। আলাউদ্দিনের মৃত্যুর ছত্রিশদিন পর কাফুর এবং তার সঙ্গীদের হত্যা করা হয়।
আমির খুসরু (১২৫৩-১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ)
আবুল হাসান ইয়ামিন আল দিন খসরু আমির খসরু দেলভি নামেই সুপরিচিত, ভারতীয় সংস্কৃতি ইতিহাসে তিনি অনুকরণ যোগ্য হয়ে আছেন। দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার তিনি অতীন্দ্রীয়বাদী সুফি এবং আধ্যাত্মিক শিষ্য ছিলেন। তিনি কেবলমাত্র কবিই ছিলেন না তিনি ছিলেন হিন্দুস্থানি মুসলিম কাওয়ালি উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রবর্তক। তিনি দিল্লির সাতজন সুলতানের সভাকবি ছিলেন। তিনি ভারতীয়, আরবি ও পার্শি সংগীতের মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। তিনি তুরস্কীয় পিতা সৈফ আদ-দিন এবং ভারতীয় মাতার বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তবলা এবং সেতার আবিষ্কার করেন এবং উন্নতমানের বীণার আবিষ্কারক হিসাবে সাফল্যলাভ করেন। তিনি তুতি-ই-হিল্ (ভারতীয় তোতা)খেতাব লাভ করেন।
তাঁর রচিত অন্যতম একটি কবিতা এরকম ছিলঃ
“আগর ফিরদৌস বার রু-ই জমিন অস্ত্ হামিন অস্ত্-ও হামিন অস্ত্-ও হামিন অস্ত্”
পৃথিবীর বুকে যদি কোথাও স্বর্গ থাকে, ভারতই সেই, ভারতই সেই।
তাঁর উল্লেখযোগ্য লেখা হল তুফা-তুস-সিখর্ (প্রথম স্থান), ওয়াসতুল-হায়াও (দ্বিতীয় স্থান)ঘুরাতুল-কামাল, বোকিয়া-নাকিয়া, নিহায়াতুল-কামাল, কিরণ-উস-সা’দেন, মিফতা-উল-ফুটোহ্ (জালালুদ্দিন খলজির জয়ের প্রশংসা), ইশকিয়া। মহানবি ডুভাস রানি খিজরজান (এক বিয়োগান্ত কবিতা গুজরাটের রাজকুমারি ডুভাস এবং আলাউদ্দিন পুত্র খিজর খান সম্বন্ধে)। মঠনবি নোহ্ স্পেহর্, (খুশরুর ভারত এবং এর সংস্কৃতির ধারণা সম্বন্ধে), তুঘলক নামা (তুঘলকদের সম্বন্ধে), খামসা-ই-নিজামি (পাঁচটি উচ্চধরণের প্রেম কাহিনী), হাসি-বাহিসট্, মাতলাউল-আনওয়ার, শিরিন ঘসরু, মজনুন-লায়লা এবং আইন্অ সিকানদারি, ইজাজ-ই-খুসরবি, খাজাইন-উল-ফুটুহ্, আফজল-উল-ফাওয়াদ (নিজামুদ্দিন আউলিয়ার কাহিনী)খলিক-ই-বারি এবং জওহর-ই-খুসরবি।
আলাউদ্দিন শাসন ব্যবস্থার বিবরণ-
আলাউদ্দিন প্রথম সুলতান যার স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল, আমদানি করা অশ্ব ছিল, প্রতি সৈনিকের বিশদ বিবরণ (চেহারা)এবং প্রত্যেকের জন্য ঘোড়া থাকত। বিদ্রোহ দমনের জন্য চরমপন্থী প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল।
(ক) ধর্মীয় বিষয়ে অর্থ প্রদান বন্ধ করেছিল এবং অবৈতনিক ভাবে ভূমি প্রদান করা হত।
(খ) দক্ষ গোয়েন্দা প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন।
(গ) মদ্য বা অন্য নেশা সামগ্রী বর্জিত হয়েছিল।
(ঘ) সামাজিক সম্মেলন, গণ্যমান্য ব্যক্তিগণের বিবাহ বিষয়ে কঠোর অনুসন্ধান করার ব্যবস্থা ছিল।
রাজস্ব সংস্কার-
(ক) চাষযোগ্য জমির পরিমাণ নির্ধারণ করে রাজস্ব ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। ‘বিশ্ব’ ছিল পরিমাপের একক।
(খ)উৎপাদিত শস্যের অর্ধেক ছিল রাষ্ট্রের প্রাপ্য।
(গ) বাড়ির কর (ঘরি)এবং গোচারণ (চরি)কর আরোপ করা হয়েছিল।
(ঘ) রাজস্ব আদায়ের জন্য বিশেষ পদ মুস্তাক রাজ সৃশটি করা হয়েছিল। বাজার ও অর্থনৈতিক ‘নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। দ্রব্যসামগ্রীর বাজার দর স্থির করা হয়েছিল। বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রীর জন্য চারটি বাজার খোলা হয়েছিল।