মুঘল সাম্রাজ্য
মুঘল সাম্রাজ্য
বাবর (১৫২৬-১৫৩০ খ্রিঃ)
তিনি ছিলেন পিতার দিকে তৈমুরলঙ্গের বংশধর। মাতা চেঙ্গিস খাঁর বংশধর। তারা ছিল চাঘতাই তুর্কি জাতি এবং তারাই মুঘল নামে পরিচিত।
তিনি ছিলেন ফরগনা (আফগানিস্তান)রাজ্যের শাসনকর্তা। তিনি তার পিতা উমর শেখ মির্জা মারা যাওয়ার পর মাত্র ১২ বছর বয়সে সম্রাট হন। বাবরকে তার সততার জন্য ‘কালান্ডার’ বলা হত।
তাকে ভারত আক্রমণের জন্য আহ্বান জানিয়েছিল দৌলত খাঁ লোদী (পাঞ্জাবের সুবাদার), আলম খাঁ (ইব্রাহিম লোদীর কাকা) এবং রানা সিংহ।
১৫২৬ খ্রিঃ প্রথম পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করেন। ইব্রাহিম লোদী লক্ষাধিক সেনাবাহিনী থাকলেও মাত্র বারো হাজার সেনা নিয়ে ‘রুমি’ ও ‘তুলঘলমা’ নামক পদ্ধতি ব্যবহার করে যুদ্ধে জয়লাভ করে। তার এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল উ-স্তাদ আলি ও মুস্তাফা।
১৫২৭ খ্রিঃ ঘানুয়ার যুদ্ধে সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করে রাজপুত রাজ্য দখল করেন। এর ফলে বাবরের সাম্রাজ্য শক্তিশালী হয়। এই যুদ্ধের পর তিনি ‘গাজি’ উপাধি ধারণ করেন।
১৫২৮ খ্রিঃ চান্দ্রেরী যুদ্ধে অন্য রাজপুত রাজা মেদিনী রাই কে পরাজিত করে চান্দেরী দুর্গ দখল করেন।
১৫২৯ খ্রিঃ ঘর্ঘরা যুদ্ধে আফগান রাজা মামুদ লোদীকে (ইব্রাহিম লোদীর ভাই)পরাজিত করে।
বাবর ছিলেন মধ্য এশিয়া ও ভারত, তৈমুর ও আকবরের যোগসূত্র।
৩০ ডিসেম্বর ১৫৩০ খ্রিঃ আগরার আমারবাগে তার মৃত্যু হয়। তার দেহ নিয়ে যাওয়া হয় আরামবাগ থেকে কাবুলে, সেখানে তাকে সমাধিত করা হয়।
বাবর তুর্কি ভাষায় তার আত্মজীবনী তুহুক-ই-বাবরি লিখেছিলেন এটি ছিল ক্লাসিক সাহিত্য। বাবরকে বলা হত রাতের কবি।
হুমায়ুন (১৫৩০-৪০ এবং ১৫৫৫-৫৬ খ্রিঃ)
তিনি কাবুলে ১৫০৮ খ্রিঃ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বাবর এবং মাতা মহিম বেগম। হুমায়ুন কখনও খারাপ গোলাপ পছন্দ করতেন না। হুমায়ুন তার সাম্রাজ্যকে সুন্দর ভাবে সাজিয়েছিলেন। তার তিন ভাই কামরান, হিন্দাল ও আশকরিকে বিভিন্ন প্রদেশের শাসন ভার দিয়ে তার সাম্রাজ্যকে সুসংগঠিত করেছিল।
দিনপানাহ দিল্লিতে তার দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন।
১৫৩২ খ্রিঃ দৌরাহর যুদ্ধে মামুদ লোদী ও তার অনুগামী আফগানীদের পরাস্ত করেন।
এই সময় শেরশাহ সুরি তার শক্তি বৃদ্ধি করে।
১৫৩৯ খ্রিঃ চৌসার কাছে শেরশাহ হুমায়ুনকে আক্রমণ করে এবং চৌসার যুদ্ধে হুমায়ুন ভীষণভাবে পরাজিত হয় এবং কোনো প্রকারে জলের ব্যাগে পালিয়ে আগ্রায় ফিরে আসে।
কিন্তু ১৫৪০ খ্রিঃ কনৌজ বা বিলগ্রামের যুদ্ধে হুমায়ুন শেরশাহের নিকট পরাজিত হয় এবং পারস্যে পালিয়ে যায়।
১৫ বছর পর ১৫৫৫ খ্রিঃ তিনি পুনরায় ফিরে আসেন।
১৫৪৫ খ্রিঃ পারস্য সম্রাটের সহায়তায় কাবুল ও কান্দাহার জয় করেন।
১৫৫৫ খ্রিঃ তার দক্ষ সেনাপতি বৈরাম খাঁর সহায়তায় প্রথম লাহোর অধিকার করেন এবং ঐ বছর ২৩ জুলাই শুর রাজা সিকান্দার শুরকে পরাজিত করে দিল্লি ও আগ্রা দখল করে মুঘল সাম্রাজ্যের পুনপ্রতিষ্ঠা করেন। এবং শূর সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
বৈরাম খাঁ ছিল হুমায়ুনের দক্ষ, বিচক্ষ্ণ ও বাধ্য সহায়ক। তিনি ছিলেন ভারত জ্যের প্রকৃত সহায়ক। হুমায়ুন তাকে তার পরিবারের শ্রেষ্ঠ প্রদীপ বলে অভিহিত করেছিলেন।
দিল্লি দখলের সাত মাস পর ১৫৫৬ খ্রিঃ পাঠাগারের সিঁড়ি দিয়ে পড়ে হুমায়ুনের মৃত্যু হয়। ঐতিহাসিক লেনপুল বলেছিলেন “হুমায়ুন জীবনকে সমস্যার মধ্যে ছুড়ে দেয় এবং সে নিজেই এটি থেকে মুক্ত করে”।
হুমায়ুন ‘ইসান-ই-কামিল’ (প্রকৃত মানুষ)উপাধি ধারণ করেন।
হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগম (বৈমাত্রেয়)হুমায়ুন নামা লিখেছিলেন।
আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিঃ)
জালালউদ্দিন মহম্মদ আকবর ছিলেন হুমায়ুনের পুত্র, মাতা ছিলেন হামিদাবানু বেগম। তিনি ১৫৪২ খ্রিঃ সিন্ধু প্রদেশের অমরকোটে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া জানতেন না।
বৈরাম খাঁর অভিভাবকত্বে মাত্র ১৪ বছর বয়সে কালানাউর এর দায়িত্ব নেন।
বৈরাম খাঁর নেতৃত্বে ১৫৫৬ খ্রিঃ দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমু বিক্রমাদিত্যকে পরাজিত করে। হিমু ছিল আদিল শাহ শুরির প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপতি তিনি দিল্লি পুনরুদ্ধার করে।
১৫৫৬-১৫৬০ খ্রিঃ পর্যন্ত আকবরের শাসন কার্য পরিচালনা করত বৈরাম খাঁ।
বি.দ্র.- হিমু ছিল দিল্লির শেষ হিন্দু রাজা। তিনি ১৪তম ও শেষ রাজা ছিলেন যে বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করে ছিলেন।
আকবরের নবরত্ন-
আবুল ফজল- তিনি ছিলেন আকবর নামার লেখক ও আইন-ই আকবর এর প্রচারক। তিনি আকবরের হিসাব রক্ষকও ছিলেন। তিনি মুঘল সেনাবাহিনীর সেনানায়ক ছিলেন।
ফৈজি- তিনি ছিলেন ঐতিহাসিক আবুল ফজলের ভ্রাতা। তিনি ছিলেন আকবরের সভাকবি এবং নবরত্নের একজন। তাকে প্রথম নিযুক্ত করা হয় আকবর পুত্রদের শিক্ষক হিসাবে। তিনি লীলাবতীকে (একটি গণিত বই)ফার্সি ভাষার অনুবাদ করেছিলেন।
তানসেন- তিনি হলেন রামতনু পান্ডে। তিনি ছিলেন একজন যন্ত্রবাদক। সে সর্বদা বাজনা নিয়েই থাকতেন। তিনি গোয়ালিয়র হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজা রামচন্দ্রের সভায় বাদক হিসাবে আসায় আকবরের দৃষ্টিগোচর হয়। পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি গীটারে সন্তর বাদক। তানসেন মিউজিকে যেন আগুন ঝরাত। তার বিখ্যাত রাগ ছিল মেঘ মলহার ও দীপক।
রাজা বীরবল- বীরবলের আসল নাম মহেশ দাস। তিনি আকবরের সাম্রাজ্যে শাসন কার্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন হাস্যরসিক/বিদুষক কবি এবং সংগীতজ্ঞ। তার জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে সম্রাট তার নবরত্ন সভায় তাকে স্থান দিয়েছিলেন। তার ডাকনাম ছিল বীরবল। আকবর তাকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন।
রাজা টোডরমল- টোডরমল ছিল আকবরের রাজস্ব বা অর্থমন্ত্রী। তিনি সাম্রাজ্যের উন্নয়নের জন্য সাম্রাজ্যকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। তার তৈরি করা পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে পরবর্তী মুঘল সম্রাটরা রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। টোডরমল শের শাহের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। ১৫৮২ খ্রিঃ আকবর তাকে উপাধি রাজা ও দেওয়ান-ই-অসরফ দেন।
রাজা মান সিংহ- মান সিংহ ছিল অম্বরের রাজা। তিনি আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে তার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি ছিলেন আকবরের প্রধান সেনাপতি। পরবর্তীকালে অম্বরের রাজা বিহারিমলের কন্যাকে আকবর বিবাহ করে এবং তার পুত্র রাজা ভগবান দাসকে আকবরের সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। মান সিংহ ছিল আকবরের যুদ্ধ জয়ের মূল কান্ডারী। হলদিঘাটের যুদ্ধ, মেবার জয়, কাবুল অধিকার ও ওড়িশা জয়ের প্রধান ভূমিকায় ছিলেন মান সিংহ।
আবদুল রহিম-খান-খান্না- আবদুল রহিম ছিলেন একজন কবি ও আকবরের সেনাপতিদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন বৈরাম খাঁর পুত্র। বৈরাম খাঁর মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রীকে আকবর তার দ্বিতীয় স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেন এবং শিশুপুত্র আবদুল রহিমকে আপন পুত্র স্নেহে পালন করেন। তিনি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
ফকির আজিয়াও দিন- তিনি ছিলেন আকবরের মুখ্য উপদেষ্টা।
মোল্লা দো পিয়জা- তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। আকবরের আমলে তার উপদেশ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেত।
১৫৬০-১৫৬২ খ্রিঃ পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য যুদ্ধ বিদ্যায় লিপ্ত ছিল এই সময় তিনি ছোটো থাকায় তার ধাতৃমাতা মহাম অঙ্গা বা মামাঙ্গা ছায়াসঙ্গীর মতো থেকেছে। এবং বৈরাম খাঁ শাসন ভার পরিচালনা করত। ১৫৬২ খ্রিঃ বৈরাম খাঁর মৃত্যু হয়।
১৫৬১ খ্রিঃ তিনি মালব আক্রমণ করেন ১৫৬১ থেকে ৬৪ খ্রিঃ পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলে মালব রাজ বাজ বাহাদুরকে পরাজিত করেন। এই সময় তার সেনাপতি ছিল আদম খান ও পীর মহম্মদ।
১৫৬৪ খ্রিঃ মধ্যপ্রদেশের গড় কাটাঙ্গা আক্রমণ করেন এই সময় রাজা ছিলেন রানি দুর্গাবতী। তিনি চিতোরের শরণাপন্ন হয় কিন্তু তিনি পরাজিত হন।
আকবর সম্পর্ক স্থাপনের পদ্ধতিতে রাজ্য জয় করেছিলেন। ১৫৬২ খ্রিঃ তিনি অম্বর আক্রমণ করেন এবং রাজা বিহারিমল তার বশ্যতা স্বীকার করলে তিনি বিহারিমলের কন্যাকে বিবাহ করেন। এবং বিহারিমলকে জয়পুরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ১৫৮৪ খ্রিঃ রাজপুত্র সেলিমের সঙ্গে রাজা ভগবান দাসের কন্যাকে বিবাহ দিয়ে তিনি তার সাম্রাজ্য মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।
১৫৭২ খ্রিঃ গুজরাট আক্রমণ করেন এবং তৃতীয় মুজাফর শাহকে পরাজিত করেন। আকবর বুলন্দ দরওয়াজা ও ফতেপুর সিকরি (১৬০২) তৈরি করেন।
১৫৭৬ খ্রিঃ হলদিঘাটের যুদ্ধে রাজা মানসিংহ (বিহারিমলের পৌত্র)ও আসিফ খাঁনের নেতৃত্ব রানা প্রতাপকে পরাজিত করে এবং রাজপুত সাম্রাজ্য দখল করে।
রাজা মান সিংহের নেতৃত্বে বাংলা, বিহার ও ওড়িশা দখল করে।
১৫৯১ খ্রিঃ মান্দ্রেশ ও ১৫৯৫ খ্রিঃ বালুচিস্তান, ফান্দাহার তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৫৮৬ খ্রিঃ কাশ্মীর ও ১৫৯৩ খ্রিঃ সিন্দ জয় করেন।
১৫৯৯ খ্রিঃ দৌলতাবাদের সুলতানা চাঁদ বিবিকে পরাজিত করে দাক্ষিণাত্য দখল করে। তার শেষ যুদ্ধ ছিল আসির গড় দুর্গ জয় ১৬০১ খ্রিঃ।
১৬০৫ খ্রিঃ আকবরের মৃত্যু হয়। তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল কাশ্মীর, সিন্দ, কান্দাহার পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।
জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭ খ্রিঃ)
আকবর পুত্র সেলিম নুরউদ-দিন-মুহম্মদ-জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন।
তিনি অধিকাংশ সময় কাটাতেন লাহোরে। যেখানে তিনি দিলখুসা উদ্যান ও ভবন নির্মাণ করেছিলেন।
কিন্তু শীঘ্রই তার বড়োপুত্র খসরু বিদ্রোহ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
তিনি পঞ্চম শিখ গুরু অর্জুন দেব সিংহকে হত্যা করেন। কারণ গুরু অর্জুন জাহাঙ্গীরের বিদ্রোহী পুত্র খসরুকে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
রানা অমর সিংহ (মহারানা প্রতাপের পুত্র)১৬১৫ খ্রিঃ জাহাঙ্গীর বশ্যতা স্বীকার করেন এবং তার পুত্র করণ সিংহকে মুঘল সাম্রাজ্যের মনসবদার পদে নিযুক্ত করেন।
১৬২২ খ্রিঃ প্যারিস সম্রাট শাহ আব্বাস কান্দাহার দখল করেন এবং মুঘলদের হাতছাড়া হয়।
জাহাঙ্গীর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল তিনি শের আফগানির বিধবা স্ত্রী মেহেরুন্নিসাকে ১৬১১ খ্রিঃ বিবাহ করেন। তার নাম দেন নুরজাহান। জাহাঙ্গীর সিংহাসনের পিছনে প্রকৃত শক্তি ছিল তার।
তিনি ছিলেন মুঘল আমলে প্রথম সাম্রাজ্ঞী যাকে নিজ গুণের জন্য ‘পাদশাহ বেগম’ বলা হত।
নুরজাহান তার পিতা মির্জা গিয়াস বেগ, ভ্রাতা আসফ খাঁ ও যুবরাজ খুররম কে নিয়ে চক্র তৈরি করেছিল। যুবরাজ খুররমের সহিত তার ভ্রাতুষ্পুত্রী মমতাজের বিবাহ দেন। তিনি তার পিতা মির্জা গিয়াস বেগকে সাত হাজারি ও ভ্রাতা আসফকে ছয় হাজারি মনসবদারের পদে নিযুক্ত করেন।
জাহাঙ্গীরের সময় আগ্রাতে ইতিমাদ ইদ্ দৌলার স্মৃতি সৌধ নির্মাণ হয় এবং সেকেন্দার আকবরের সমাধির কাজ শেষ করেন জাহাঙ্গীর।
ঐতিহাসিক ক্যান্টেন হকিন্স (১৬০৮-১১)ভারত ভ্রমণের সময় জাহাঙ্গীরের ৪০০ মনসবদার দেখে তাকে ইংলিশ খান বলেছিলেন। স্যার টমাস রো (১৬১৫-১৯)তার রাজত্বকালে ভারতে এসেছিলেন।
তার সময়কে মুঘল আমলে স্বর্ণযুগ বলা হয়। ১৬২৭ খ্রিঃ জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয়।
শাজাহান (১৬২৮-১৬৫৮ খ্রিঃ)
তিনি ছিলেন একজন দক্ষ শাসক। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লিতে স্থান্তর করেন।
তার রাজত্বের প্রথম দিকে বুন্দেল খন্ডের রাজা জুঝর সিং বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা খান জাহান লোদী বিদ্রোহ করেন। তিনি এই বিদ্রোহ দমন করেন।
শাজাহান তার সাম্রাজ্য বিস্তারে সফলতা পেয়েছিল। আহমেদনগর এবং বিজয়পুর তার সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করে। ১৬৩৬ খ্রিঃ গোলকুন্ডা মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে।
তিনি উত্তর-পূর্বে রানা প্রতাপ সিংহের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে শ্রীহট্ট জেলা পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেন।
তার পুত্র ঔরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের সুবেদার নিযুক্ত করেন।
তার আমলে দিল্লি নগরীর নামকরণ করেন ‘শাজাহানবাদ’, আগ্রার নামকরণ করা হয় ‘আকবরাবাদ’।
মুঘল সম্রাট শাজাহান শাজানাবাদের অভ্যন্তরে সুপ্রসিদ্ধ দুর্গ তৈরি করেন। যমুনা নদীর পূর্বে চারটি বড়ো দরজা, দুটি দরজা ও ২টি বুরুদ সহ নির্মিত হয় এই দুর্গ। যার নাম ছিল ‘কিলা-ই-মুবারক’ যা লালকেল্লা নামে পরিচিত। ১৫৫৭ খ্রিঃ পর্যন্ত এটাই ছিল মুঘলদের এবং পরবর্তী রাজাদের রাজধানী।
তার রাজত্বকালকে মোঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ বলা হয়।
তাজমহল
‘তাজমহল’ হল আগ্রার নিকট ভালোবাসার স্মৃতি সৌধ। শাজাহান তার প্রিয় পত্নী আর্জুমান্দ বানু বেগমকে নাম দেওয়া ‘মমতাজ’। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই সৌধ নির্মাণ করেন। ১৬৩১ খ্রিঃ মমতাজ তার চতুর্থ পুত্রের জন্মের সময় তার মৃত্যু হয়। এই সৌধ তৈরি করতে সময় লেগেছিল ২২ বছর (১৬৩১-১৬৫৩)। ২২ হাজার মিস্ত্রি প্রতিদিন কাজ করে ২২ বছর ধরে এই সৌধ নির্মাণ করেছিল। যার মূল কারিগরি বা নকশা তৈরি প্রধান দায়িত্ব ছিল ঈশা খাঁর হাতে। সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি দেয়ালে কোরানের বাণী লিখেছিল আমানত খাঁ মিরজা। মীর আব্দুল করিম এবং মুক্করিমল খাঁ তাজমহলের আর্থিক দিক দেখভাল করেছিল। এটি ছিল মুঘল আমলের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেনঃ ‘Teardrop on the cheek of eternity’
শাজাহান শ্বেত পাথরের মোতি মসজিদ তৈরি করেছিলেন। এছাড়া তিনি ময়ূর সিংহাসন তৈরি করেছিলেন যা স্বর্ণদ্বারণ নির্মিত।
তার জীবনের শেষ খুব দুঃখের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়ঃ তার চারপুত্র দারা, সুজা, ঔরঙ্গজেব ও মুরাদ এর মধ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়।
ঔরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭)
শাজাহানের চারপুত্র হল দারা সিকো, শাহ সুজা, ঔরঙ্গজেব ও মুরাদ বক্স। এবং তিন কন্যা ছিল জাহান আরা, রোশন আরা এবং গৌহর আরা।
এমত অবস্থায় শাজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার পুত্রদের বিভিন্ন প্রদেশের দায়িত্ব দেন। দারা ছিল দিল্লি, শাহ বাংলা, মুরাদ গুজরাট এবং ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য।
ঔরঙ্গজেব দারাসিকোকে ধর্মাট, সামুগড় ও দেওয়াই এর যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। এবং আততায়ী দ্বারা নিহত করেন।
ঔরঙ্গজেব ১৬৫৯ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে খাজোয়ার যুদ্ধে সুজাকে পরাস্ত করেন ও নিহত করেন।
১৬৯০ খ্রিঃ মধ্যে ঔরঙ্গজেবের সাম্রাজ্য পশ্চিমে কাবুল থেকে পূর্বে চট্টগ্রাম ও উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে কাবেরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
ঔরঙ্গজেবের নির্দেশে বাংলার শাসক মীর্হামুল্লা ১৬৬১ খ্রিঃ কুচবিহার দখল করেন এবং স্থান্টির নাম রাখেন আলমগীর নগর।
১৬৬৩ খ্রিঃ অহোম্রাজ জয়ধ্বজ মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে সন্ধি করেন।
শায়েস্তা খাঁ আরাকান রাজকে পরাজিত করে চট্টগ্রাম এবং মগ ও পোর্তুগিজ জলদস্যুদের পরাজিত করে ‘সন্দীপ’ দখল করেন। ঔরঙ্গজেব উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ‘অগ্রসর নীতি’ অবলম্বন করেন।
মীর জার্মুল্লা পরবর্তী বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন ঔরঙ্গজেবের মাতুল শায়েস্তা খাঁন। তিনি পোর্তুগিজদের দমন করে সন্দীপ (১৬৬৫ খ্রিঃ)এবং আরাকানরাজকে পরাস্ত করে চট্টগ্রাম দখল করেন (১৬৬৬ খ্রিঃ)।
ঔরঙ্গজেব খাঁটি ইসলামীয় আচরণ বিধি সর্বসাধারণের কাছে প্রচারের জন্য রচনা করেন ফতোয়া-ই-আলমগিরি।
ঔরঙ্গজেবের রাজনৈতিক ব্যাপারে উলেমা নির্ভরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন যে দুজন মুসলিম আভিজাত তারা হলেন-মহাবৎ খাঁ, মীর্জা লারাস্পা।
জয়সিংহ, রামসিংহ ও যশোবন্ত সিংহ প্রভৃতি বিখ্যাত রাজপুত সেনাপতি ঔরঙ্গজেবের অধীনে উচ্চপদে বহাল ছিলেন।
ঔরঙ্গজেব শিখদের নবম গুরু তেগবাহাদুরকে হত্যা করেছিলেন (১৬৭৫ খ্রিঃ)। তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি হল ‘শিরদিয়া সার না দিয়া’।
ঔরঙ্গজেব প্রধানত মারবাড় ও মেবার-এই দুই রাজপুত রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।
ঔরঙ্গজেব দীর্ঘ ত্রিশ বছর রাজপুতানার যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন।
রাঠোর বীর দুর্গাদাস ছিলেন মারবাড়ের রাজা যশোবন্ত সিংহের অনুচর।
পরবর্তী মোঘল শাসকগণ (১৭০৭-১৮৫৭ খ্রিঃ)
বাহাদুর শাহ প্রথম (১৭০৭-১২ খ্রিঃ)-
ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোঘল সম্রাটরা ছিল পুতুল, রাজ্য প্রধান ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। প্রকৃত ক্ষমতার অধিকার যা অমলাবর্গের হাতে। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর তিন পুত্র মুয়াজ্জম, আজম ও কামবক্স ক্ষমতার অধিকার নিয়ে ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। মুয়াজ্জম ‘প্রথম বাহাদুর শাহ’ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে। অন্যদিকে আজম নিজেকে ‘সম্রাট’ হিসাবে ঘোষনা করেন এবং কামবক্স ‘দিন পনাহা’ উপাধি নিয়ে সিংহাসন দখল করার চেষ্টা করেন।
শেষ পর্যন্ত বাহাদুর শাহ তাঁর ভাইদের পরাজিত করে ‘প্রথম শাহ আলম’ উপাধি নেন। ঐতিহাসিক কাফি খাঁ বাহাদুর শাহকে ‘শাহ-ই-বেখবর’ আখ্যা দেন।
তিনি শিবাজির পৌত্র শাহুজি (শম্ভুজির পুত্র)-কে ১৮ বছরের বন্দিবদশা থেকে মুক্তি দেন।
তিনি মারওয়াড় ও মেবারের স্বাধীনতা স্বীকার করেন। প্রচলিত ‘জিজিয়া কর’ তুলে দেন।
জাহানদার শাহ (১৭১২-১৪ খ্রিঃ)
বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তাঁর চার পুত্রের মধ্যে জাহানদার শাহ অন্য ভাইদের পরাস্ত করে ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে মোঘল সম্রাট হন। ক্ষমতা পেতে তাকে সাহায্য করেছিল অমাত্য (আমির)জুলফিকার খাঁন। দুজন ক্ষমতাশালী অমাত্য আবদুল্লাহ খান ও হুসেন আলি খানের (যারা সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় নামে পরিচিত)দ্বারা জাহানদার শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন।
ফারুকশিয়ার (১৭১৩-১৯ খ্রিঃ)
সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের সাহায্যে ফারুকশিয়ার জাহানদারকে হত্যা করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। ফারুকশিয়ার জুলফিকতার খাঁনকে হত্যা করেন।
শিখনেতা বান্দা বাহাদুরকে ফারুকশিয়ার ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুদন্ড দেন।
১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ দূত সুরম্যানকে বার্ষিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বিনাশুল্কে বাণিজ্যের ফরমান দেন।
ফারুকশিয়ার সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা করলে, সম্রাট ফারুকশিয়ার নিজেই সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় দ্বারা নিহত হন।
রফি-উদ-দরজাতকে ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ফেব্রুয়ারি দিল্লির সিংহাসনে বসান।
এর পর সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় রফি-উদ-দরজাতকে হত্যা করে ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে রফি-উদ-দৌলাকে দিল্লির সিংহাসনে বসান।
রফি-উদ দৌলা (জুন-নভেম্বর ১৭১৯ খ্রিঃ)
রফি-উদ-দৌলা দ্বিতীয় শাজাহান উপাধি নেন।
মহম্মদ শাহ (১৭১৯-৪৮ খ্রিঃ)
সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের সহযোগিতায় মহম্মদ শাহ সিংহাসনে বসেন। তিনি উনত্রিশ বছর রাজত্ব করেন।
মহম্মদ শাহের পূর্ব নাম ছিল রোশন আকবর।
১৭২০ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ শাহ সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়কে হত্যা করেন।
এই মোঘল সম্রাট কত্থক নৃত্যে পারদর্শী ছিলেন। তিনি শাসনকার্যের থেকে আমোদ-প্রমোদ ও নানবিধ রঙ্গ তামাশায় মত্ত থাকতেন। সে কারণে মহম্মদ শাহ ইতিহাসে ‘রঙ্গীলা বাদশাহ’ নামে পরিচিত ছিলেন।
তাঁর সময় হায়দ্রাবাদের নিজাম বংশ, মুরশিদকুলি খাঁর নেতৃত্বে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ও রোহিলাখন্ড স্বাধীন রাজ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন।
মহম্মদ শাহের রাজত্বকালে ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে পারস্য সম্রাট নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করেন।
নাদির শাহ কোহিনুর মণি, ময়ূর সিংহাসন সহ প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে পারস্যে (ইরানে)ফিরে যান। বর্তমানে ময়ূর সিংহাসন লন্ডন মিউজিয়ামে রয়েছে।
আহম্মদ শাহ (১৭৮৪-৫৪খ্রিঃ)
তাঁর সময় আফগানিস্তানের শাসক আহম্মদ শাহ আবদালী প্রথম ভারত আক্রমণ করেন।
১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে মারাঠা নাঠক মলহার রাও হোলকার দিল্লি আক্রমণ করেন।
আহম্মদের উজির (প্রধানমন্ত্রী)ইমাদ-উল-মুলক আহম্মদকে দুই চোখ অন্ধ করে আজিমুদ্দিনকে সিংহাসনে বসান।
আজিজুদ্দিন দ্বিতীয় আলমগীর (১৭৫৪-৫৯ খ্রিঃ)
ইমাদ-উল-মুলুকের সহযোগিতায় আজিজুদ্দিন ‘দ্বিতীয় আলমগীর’ নামে মোঘল সম্রাট হন। সিংহাসনে বসেই সম্রাট ইমাদ-উল-মুলুকের প্রধান সেনাপতি বলবাস খাঁনকে হত্যা করেন। এর পর ইমাদ-উল-মুলুক রেগে গিয়ে দ্বিতীয় আলমগীরকে হত্যা করেন এবং তাঁর পুত্র যুবরাজ আলি গহ্বরকে দিল্লির সিংহাসনে বসান।
আলি গহ্বর দ্বিতীয় শাহ আলম (১৭৫৯-১৮০৬ খ্রিঃ)
আলি গহ্বর ‘দ্বিতীয় শাহ আলম’ নামে দিল্লির সিংহাসনে বসেন।
১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে তিনি হেরে যান।
১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় শাহ আলম বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ‘বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার’ দেওয়ানী অধিকার (রাজস্ব আদায়ের অধিকার)ইংরেজকে দিতে বাধ্য হন।
১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা দিল্লি অধিকার করে। এর পর মোঘলদের প্রধান ও একমাত্র বাসস্থান ও কর্মস্থল ছিল আগ্রা।
দ্বিতীয় আকবর (১৮০৬-৩৭)- তিনি রামমোহন রায়কে রাজা উপাধি দেন। তিনি রামমোহন রায়কে উচ্চশিক্ষার লন্ডন পাঠান।
দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ (১৮৩৭-৫৭)
এনি ছিলেন শেষ মোঘল সম্রাট। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহে অংশগ্রহণ করার অপরাধে দ্বিতীয় বাহাদুরকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেন ইংরেজরা। তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করে ইংরেজরা। শেষ মোঘল সম্রাট রেঙ্গুনে নির্বাসিত অবস্থায় ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন।
সিপাহি বিদ্রোহ (মহাবিদ্রোহ)-র সময় হিন্দুস্থানের সিপাহীরা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ‘হিন্দুস্থানের সম্রাট’ বলে ঘোষণা করেছিলেন।
মোঘল আমলের দরবারী রাজনীতি
- মোঘল আমলে আমির ওমরাহদের মধ্যে তিনটি গোষ্ঠী বিদ্যমান ছিল। যথাঃ ইরানী, তুরানী ও হিন্দুস্থানী।
মুঘল শাসন ব্যবস্থা
প্রথম অবস্থায় তাদের সাম্রাজ্যকে সুবায় বিভক্ত করা হত। সুবা হল সরকার। সরকার থেকে পরগনা এবং পরগনা থেকে গ্রাম।
বাব্র ও হুমাতুনের প্রধানমন্ত্রীদের বলা হত ভকিল। কিন্তু ভকিল ছিল বৈরাম খাঁর সময় পর্যন্ত।
উজির ছিল প্রধানমন্ত্রী।
দেওয়ান ছিল ভূমি রাজস্ব মন্ত্রক বা বিভাগ।
মীর বক্সি- ছিল সেনাবাহিনী বিভাগ।
মান-ই-সামান- প্রকৃত গৃহ কর্তা।
কাজি-উল-কাজাট- বিচার বিভাগ, কাজিকে সাহায্য করত মুফতি।
সাদর-উস-সাদর- সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মন্ত্রক।
মুস্তাফি- লেখক
আমিল- জনসাধারণের বিচারক এবং বিচারব্যবস্থা সহায়ক।
কুয়ানুনগো- প্রধান হিসাব রক্ষক
লাম্বারদার- গ্রাম প্রধান
আকবরে সময় ১৫টি সুবা ছিল। ঔরঙ্গজেবের আমলে ২১টি সুবা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।
জমিকে ভাগ করা হয়েছিল খালিমা (শস্যের জমি), জাগির (উন্নত শস্যের জমি) এবং ইনাম (উন্নত জমি ও বাসস্থান)।
মোঘল সম্পর্কিত তথ্যসমূহ
দিল্লির সুলতানরা চিত্রকলার সমঝদার না হলেও সে যুগে প্রাদেশিক মুসলিম শাসকরা চিত্রকলার সমাদর করতেন।
সুলতানি আমলে জৈনপুর, মান্ডু, আমেদাবাদ প্রভৃতি স্থানের মুসলিম শাসকগণের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মিনিয়েচার’ চিত্রের বিকাশ ঘটেছিল।
জৈন মন্দির সংলগ্ন পাঠাগার বা জ্ঞানভান্ডারে মিনিয়েচার চিত্রের বহু নিদর্শন দেখা যায়।
মোঘল চিত্রকলায় প্রাকৃতিক দৃশ্য, গাছ, পশু পাখির চিত্র বিষয়বস্তু হিসাবে স্থান পায়।
মোঘল চিত্রকলা ‘রাজ দরবারে’ বিকশিত হয়।
মোঘল সম্রাটের মধ্যে আকবরই প্রথম যিনি চিত্র কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
হুমায়ুনের আমলে দুজন বিখ্যাত পারসিক শিল্পী আবদুস সামাদ ও মীর সৈয়দ আলি পারস্য থেকে ভারতে আসেন। কিন্তু এদের শৈল্পিক বিকাশ ঘটে আকবরের আমলে।
মীর সৈয়দ আলি এসেছিলেন তাব্রিজ থেকে, আবদুস সামাদ এসেছিলেন সিরাজ থেকে।
অনুচিত্র সৃষ্টির দক্ষতার জন্য খাজা আবদুস সামাদ ‘শিরিন-কালাম’ বা ‘সুন্দর কলম’ উপাধি পেয়েছিলেন।
মীর সৈয়দ আলি পিতা মীর মুসাবির পারস্যের শাহ তহ্ মাসপের দরবারে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ছিলেন।
মীর সৈয়দ আলি হুমায়ুনের কাছ থেকে নাদির-উল-অসর্ (পৃথিবীতে অতুলনীয়) উপাধি গ্রহণ করেন।
আকবরের বাল্যকালের ছবি ‘হামজানামা’ নামক পান্ডুলিপিতে পাওয়া যায়। যাতে ১২০০ চিত্র ছিল।
আবুল ফজলের মতে আকবরের ১৭জন চিত্রকরের মধ্যে ১৩ জনই ছিলেন হিন্দু।
পারসিক চিত্রধারা অনুসারে মোঘল ভারতীয় চিত্রধারা বিকাশে দুটি উল্লেখযোগ্য চিত্রকর হলেন বায়াজিদ এবং তাঁর শিষ্য আগামারিক।
মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন খাঁটি কলা রসিক লোক। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই তত্ত্বে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।
জাহাঙ্গীরের আমলেই মুঘল চিত্র শিল্পের সুবর্ণযুগ শুরু হয়।
স্যার টমাস রো জাহাঙ্গীরকে একজন চিত্রকলার শ্রেষ্ঠ অনুরাগী বলে অভিহিত করেন।
জাহাঙ্গীর একমাত্র মুঘল সম্রাট যিনি প্রকৃতির আকর্ষণে ১৯ বার কাশ্মীর পরিভ্রমণ করেন।
জাহাঙ্গীরের দরবারের প্রধান চিত্র শিল্পী হলেন হিরাটের প্রখ্যাত শিল্পী আকা-রিজা। যিনি পারস্যের বিখ্যাত শিল্পী আবু-ই-হাসানের পুত্র।
জাহাঙ্গীরের আমলে বিরল পশুপাখির চিত্রাঙ্কনে সবচেয়ে দক্ষ ছিলেন ওস্তাদ মনসুর।
আকা রিজার শিল্পকর্মে সন্তুষ্ট হয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁকে “নাসির-উস-জামান” (যুগের বিস্ময়) উপাধি দেন।
জাহাঙ্গীরের আমলে প্রতিকৃতি অঙ্কনে অদ্বিতীয় ছিলেন বিষেণ দাস।
জাহাঙ্গীর বিষেণ দাসকে প্রতিকৃতি অঙ্কন শিক্ষার জন্য পারস্যে পাঠিয়ে ছিলেন।
জিশু খ্রিস্টের ছবি জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে প্রিয় ছিল।
জাহাঙ্গীরের দরবারে নিযুক্ত ফারুক বেগ ছিলেন একজন মোঙ্গলীয় চিত্রশিল্পী।
ওস্তাদ মনসুরের আঁকা সাইবেরিয়ান সারসটি কলকাতা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
জাহাঙ্গীরের আমলে প্রারম্ভিক মুঘলরীতির ‘তিন চতুর্থাংশমুখ চিত্রণের স্থলে ‘অর্ধমুখচিত্রণ’ রীতি প্রচলিত হয়।
দশরথের পুত্রেষ্ঠি যজ্ঞ, রাবণের সীতাহরণ ও জটায়ু বিষেণ দাসের আঁকা বিখ্যাত চিত্র।
জাহাঙ্গীরের সময়ই সর্বপ্রথম ইউরোপীয় চিত্রশিল্প ভারতীয় শিল্পীদের প্রভাবিত করে।
জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রকর বিচিত্র ও আবুল হাসানের মৌলিক প্র্যাসের ফলে রূপকাত্মক চিত্রকলা দ্রুত বিকাশ লাভ করেছিল।
পার্সিব্রাউনের মতে-‘জাহাঙ্গীরের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে মুঘল চিত্রশিল্পের আত্মা বিলুপ্ত হয়’।
জাহাঙ্গীর পুত্র শাজাহান স্থাপত্য শিল্পের অনুরাগী হওয়ায়, চিত্রশিল্প অবহেলিত হয়।
শাজাহান ব্যক্তিগত ভাবে নিজের বীরত্বমূলক চিত্রাঙ্কনের প্রতি বিশেষ অনুরাগ দেখান।
শাজাহানের পুত্র দারাসিকো চিত্রশিল্পের পূজারি ছিলেন। তাঁর চিত্রাব্লির অ্যালবাম ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রক্ষিত আছে।
ঔরঙ্গজেবের মতে চিত্রাঙ্কন ছিল বিলাসিতা এবং ইসলামের আদর্শ বিরোধী।
মুঘল চিত্রশিল্প
| সম্রাটের নাম | চিত্রশিল্পীদের নাম | উল্লেখযোগ্য চিত্রকলা |
|---|---|---|
| হুমায়ুন | মীর সৈয়দ আলি তাব্রিজি, খাজা আবদুস এছাড়া মৌলানা দোস্ত, মৌলানা সরবেশ মহম্মদ, মৌলানা ইউসুফ প্রমুখ। | দস্তান-আমীর হামজা চিত্র এই সময় শুরু হয়। আকবরের আমলে সম্পূর্ণ হয়। |
| আকবর | আবদুস সামাদ, সৈয়দ আলি, ফারুক বেগ, দশবন্ত, বসাওয়ান, কেশব (কেসু) লাল, মুশকিন, মুকুন্দ, ফারুক কালমাক, মাধব, জগ্ননাথ খেমকরণ, তারাচাঁদ, সানওয়াল দাস, হরিবংশ, রাম, খসরুকুলি প্রমুখ। | হামজানামা, নলদময়ন্তী, কালিয়দমন, জাফরনামা, চিঙ্গীজনামা, রণমনামা, রামায়নের চিত্রাবলী, আকবরনামা গ্রন্থচিত্রণ। |
| জাহাঙ্গীর | ফারুক বেগ, মহম্মদ নাদির, মহম্মদ মুরাদ, আকারিজা, ওস্তাদ মনসুর, বিষেণ দাস, বিচিত্র মনোহর, গোবর্ধন প্রমুখ। | জটায়ুবধ, রাবণের সীতা-হরণ, দশরথের পুত্রেষ্ঠি যজ্ঞ, সাইবেরীয় সারস, চিনার গাছে লম্ফনরত কাঠবেড়ালী, রাজ কানোয়ার, ‘গজল’ ও ‘রুবাইৎ’। |
| শাজাহান | নাদিরসমর কান্দি, মির হাসান, অনুপ, চিত্রা, চিত্রামণি। | ময়ূর সিংহাসনে উপবিষ্ট সম্রাট, টমাসরো দৌতের সময় দরবারে সম্রাট। |
| ঔরঙ্গজেব | - | চিত্রকলার প্রতি বিমুখ ছিলেন। |
| দারাসিকো | অনুপছত্তর, চিতরমান | শাজাহান নামার চিত্রায়ণ। |