ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা
ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা এবং আধুনিক শিক্ষার প্রসার
প্রথম পদক্ষেপ (1758-1812)
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিঞ্চিৎ আগ্রহ প্রদর্শন করেছিল এই সময়ে। দুটি কাজে তারা শিক্ষা প্রসারের সাহায্যে আগ্রহ দেখিয়েছিল-
(i) কলকাতায় ওয়ারেন হেস্টিংস প্রবর্তিত 1781 সালে মুসলিমদের আইন এবং কিছু বিশ্যে জ্ঞানার্জনের জন্য মাদ্রাসা স্থাপন।
(ii) 1972 জোনাথন ডানকান দ্বারা বারাণসীতে সংস্কৃত কলেজের স্থাপনা, হিন্দু আইন এবং দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষার জন্য।
এই দুটি সর্বদা শিক্ষিত ভারতীয়দের কোম্পানির কোর্টে শাসন ব্যবস্থার আইনি প্রয়োগের ব্যাপারে মতামত গ্রহণ করত।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ (1813-1853)
খ্রিস্টান মিশনারি এবং মানবাধিকার গোষ্ঠী হতে কোম্পানির উপর প্রবল চাপ আসতে লাগল ভারতে আধুনিক শিক্ষার প্রসারে অধোগতির কারণে। শেষ পর্যন্ত কোম্পানি নতিস্বীকারে বাধ্য হয়ে 1813 এর অ্যাক্ট অনুযায়ী প্রতি ভারতীয় শিক্ষিতদের জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা প্রদানে রাজি হয় এবং আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বার ভারতীয়দের জন্য খুলে দেয়।
প্রথম পর্যায়ের দুটি বিশ্যে কোম্পানিকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
(i) শিক্ষার ব্যাপারে আধুনিক পশ্চিম শিক্ষা বা ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় শিক্ষার শিক্ষানীতির অনুসরণ।
(ii) ভারতীয় ভাষা বা ইংরেজি ভাষার ব্যবহার স্কুল এবং কলেজ পশ্চিমী শিক্ষার প্রসারে।
এই মতবিরোধ 1835 সালে যখন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এবং রাজা রামমোহন রায় ইংরেজি ভাষায় পক্ষে মত দিলেন।
1844 সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ ভারতীয় শিক্ষিতদের ইংরেজি স্কুলে সরকারি চাকুরির ছাড়পত্র দিলেন। এতে সফলতা আসল। বাংলা, চেন্নাই এবং মুম্বাইতে এর সুফল দেখা গেল এবং সেখানে স্কুল ক্লেজের সংখ্যা বাড়তে লাগল।
দ্বিতীয় পদক্ষেপে আরও তিনটি উল্লেখনীয় সাফল্য এসেছিল-
(i) মিশনারীরা প্রবল উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিকতা আনতে সচেষ্ট হল।
(ii) মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ল কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশে পেশামূলক শিক্ষার অভিযান শুরু হল।
(iii) লর্ড ডাইহৌসির সমর্থনে বালিকাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম উন্নতি হল।
সরকারের উদ্যোগে কিছু ইংরেজি স্কুল, কলেজ স্থাপন হল কিন্তু দেশের প্রকৃত জনগণের জন্য ছোটো বিদ্যালয় বা পাঠশালার দিকে সরকারের কোনো রকম পদক্ষেপ লক্ষ করা গেল না।
সরকারের এই গাফিলতি ঢাকতে, ব্রিটিশ সরকার ‘নিম্নাভিমুখী পরিস্রুত’ পদ্ধতির আশ্রয় নিল যেমন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা উপর স্তর হতে নিম্নস্তরে যাবে।
এই পদ্ধতি ব্রিটিশ ভারত ছাড়বার পূর্ব পর্যন্ত বহাল ছিল, পরে 1854 সালে এই পদ্ধতির সরকারিভাবে সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্তি হয়।
তৃতীয় পদক্ষেপ (1854-1900)
1854 সালের শিক্ষাব্যবস্থার দ্রুত সম্পাদনকে ‘উডস ডিসপ্যাচ’ নামে অভিহিত করা হয়। (স্যার চার্লস উড প্রথম সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া নির্বাচিত হয়েছিলেন।)
এই সময়টিকে ভারতে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ম্যাগনা কাটা’ অ্যাখ্যা দেওয়া হয়।
পরিস্রুত পদ্ধতির সম্পূর্ণভাবে অবসান হয় এবং সর্বজনে শিক্ষা, বালিকাদের শিক্ষা, ভাষাগত উন্নতিসাধন এবং ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন হয়।
এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট চালু হয় মুম্বাই, চেন্নাই, বেঙ্গল, নর্থওয়েস্টার্ন প্রভিন্স এবং পাঞ্জাবে 1855 সালে। উচ্চতম পদ পূরণ করবার স্বার্থে ইন্ডিয়ান এডুকেশন সারভিস চালু হয় 1897 সালে।
কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাই, পাঞ্জাব এবং এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি স্থাপিত হয় যথাক্রমে 1857 জানুয়ারি, 1857 জুলাই, 1857 সেপ্টেম্বর, 1882 এবং 1887 সালে।
লর্দ রিপন ‘হান্টার কমিশন’ বসান শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতির জন্য-
(i) ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড এবং মিউনিসিপ্যালিটি প্রথামিক শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্ব পায়।
(ii) সরকারের হাতে কয়েকটি স্কুল-কলেজ ব্যতীত বাদবাকি সবগুলিই বেরকারিকরণ করা হয়।
চতুর্থ পদক্ষেপ (1901-1920)
লর্ড কার্জন ইউনিভার্সিটি কমিশনের দায়িত্ব 1902 সালে থমাস র্যালের হাতে দেন। র্যালের মত অবলম্বনে 1904 সালে ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট চালু হয়।
এতদিন পর্যন্ত শুধুমাত্র পরীক্ষার জন্য একটি সংগঠন ছিল, এখন থেকে সময় বিশেষে শিক্ষাগার নিরীক্ষণ, দ্রুতগতির কাগজপত্র বা টাকা-পয়সার লেন্দেন এবং কড়া ও স্বচ্ছভাবে ইউনিভার্সিটির অধীনে নিযুক্তিকরণ প্রভৃতি কাজের সুবিধার জন্য আলাদা বডি তৈরি হয়।
জাতীয়তাবাদীরা সরকারের এইরকম ইউনিভার্সিটির ওপর অধিকারের প্রচণ্ড সমালোচনা করতে থাকে।
1910 সালে একটি আলাদা এডিকেশন ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়।
স্যাডলার কমিশনের লর্ড চেমসফোর্ড রিভিউ কমিটির প্রধান নিযুক্ত হন, তাঁর অধীনে দুজন ভারতীয় ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখার্জী এবং ডঃ জিয়াউদ্দিন আহমেদ। এই কমিশনের মতানুসারেঃ
(i) মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা মাধ্যমিক শিক্ষাপর্ষদের অধীনে এবং কলেজের ডিগ্রি কোর্স তিন বৎসরের।
(ii) বেনারস, পাটনা, মাইসোর, আলিগড়, ঢাকা লখনউ এবং ওসমানিয়া, মোট সাতটি নতুন ইউনিভার্সিটি যুক্ত হয়। চূড়ান্ত ইউনিভার্সিটির সংখ্যা দাঁড়ায় বারো।
কাশী বিদ্যাপীঠ এবং জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া স্থাপিত হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম পাস ও অনার্স-এই দুইভাগে বিভক্ত হয়েছিল।
পঞ্চম দশা (১৯২৭-১৯৭৪)
সরকারিভাবে ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীনে আসে। এটি প্রতিটি প্রভিন্সের নিয়মানুযায়ী করা হয়। এইভাবে এটি সব জায়গায় ব্যাপ্ত হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল (১৯৪৭ সালে ২০টি); উচ্চশিক্ষার মান উন্নতি হয়েছিল (স্যাডলার কমিশনের কারণে); অন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় বোর্ড গঠিত হয় (১৯২৪) এবং আন্তঃ মহাবিদ্যালয় ও আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম শুরু হয়।
নারীশিক্ষা এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেণিদের শিক্ষার ক্ষেত্রে লক্ষ্যপূরণ হয়।
হারটগ কমিটি (১৯২৯)
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতির জন্য নীতি নির্ধারিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় ভরতি এবং শিল্প ও বাণিজ্যের বিষয়ে পড়াশোনার নানা পাঠক্রমের মনোনয়ন দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উন্নতি করা উচিত বলা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষার ‘ওয়াধা স্কিম’ (১৯৩৭) হরিজনের জন্য গান্ধিজির কিছু ‘আর্টিকল’ পাস হওয়ার পর জাকির হুসেন কমিটি দ্বারা করা হয়।
সারগিয়ান্ট প্ল্যান অব্ এডুকেশন (১৯৪৪)
প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন।
৬-১১ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষা।
উচ্চ বিদ্যালয়কে দুপ্রকার করা হয়-(ক) অ্যাকাডেমিক (খ) টেকনিকাল ও ভোকেশনাল।
‘ইন্টার মিডিয়েট’ কোর্স তুলে দেওয়া।