পৃথ্বীরাজ চৌহান
পৃথ্বিরাজ তৃতীয় (১১৭৯-১১৯২)মুসলিম ঐতিহাসিকগণ রাই পিথাউরা বলতেন, রাজপুত চৌহান (চাচানাম)রাজ্যের রাজা ছিলেন, যিনি দ্বাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্থে উত্তর ভারতে রাজত্ব করতেন। তাঁর পিতা ছিলেন সোমেশ্বর চৌহান এবং স্ত্রী ছিলেন কর্পূরওয়ালী। বাল্যকালেই তিনি রাজা হন এবং প্রণয়ে আবদ্ধ হন, জয়চন্দ্র ছিলেন কনৌজের রাজা। এ বিষয়ে একটি প্রণয়সুলভ কাহিনী প্রচলিত আছে। পৃথ্বীরাজ রাজ্যের একজন প্রজা, পৃথ্বীরাজের সভাকবি ছিলেন চাঁদ বরদাই। তাঁর রাজধানী বর্তমান রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের কিয়দঅংশ এবং-পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। চাঁদ বরদাই পৃথ্বিরাজকে প্রেমিক, বলশালী এবং সর্বাপেক্ষা নির্ভিক রাজা বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর দ্রুত উত্থানে তখনকার কনৌজেয় শাসনকর্তা জয়চাঁদ গাড়ওয়ালা বিদ্বেষ পোষণ করতে লাগলেন এবং দুজনের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হল। সংযোগিতা লোক কাহিনীতে সংযুক্তা নামে পরিচিত ছিলেন এবং তিনি পৃথ্বীরাজের প্রেমে পড়েন এবং গোপনে যোগাযোগ চলতে থাকে। তাঁর পিতা এবিষয় জানতে পেরে নিরাপদে তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তিনি স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেন, যেখানে সংযুক্তা নিজের ইচ্ছায় বর নির্বাচন করবেন। জয়চাঁদ অনেক রাজপুত্রদের আমন্ত্রণ জানালেন যারা তাঁর পদমর্যাদার সমান। পৃথ্বিরাজকে অপমানিত করার জন্য জয়চাঁদ স্বয়ম্বর সভার দরজায় দারোয়ান হিসেবে পৃথ্বিরাজের একটা প্রতিমূর্তি স্থাপন করলেন। এই খবর শুনে পৃথ্বিরাজ এলেন। তিনি তাঁর মতলব সংযুক্তাকে জানালেন।
উৎসবের দিনে সংযুক্তা অন্তপুর থেকে স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত হলেন। এবং সম্মিলিত রাজপুত্রদের অতিক্রম করে দরজায় পৌঁছে পৃথ্বীরাজের প্রতিমূর্তিতে মাল্যদান করলেন এবং প্রতিমূর্তির আড়ালে পৃথ্বিরাজ লুকিয়ে ছিল এবং সংযুক্তাকে ঘোড়ায় চড়িয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল। জয়চাঁদের সৈন্যরা তাড়া করেও ধরতে পারল না। এর ফলে দুজনের মধ্যে যুদ্ধ হল এবং ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হল। রাজপুত রাজধানী দুর্বলত হয়ে পড়ল।
দ্বিতীয় ওয়াইন-এর যুদ্ধের পর পৃথ্বিরাজ বন্দি হল এবং মহমুদের কাছে তাঁকে নিয়ে আসা হল।
রাগান্বিত হয়ে তিনি ঘোরীর চোখে স্থির হয়ে চোখ রাখলেন। ঘোরী তাঁকে চোখ নামাতে আদেশ করলেন-তার উত্তরে পৃথ্বীরাজ বললেন যে রাজপুতেরী চোখ মৃত্যুকালে নত হয়। এই শুনে ঘোরী অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন জ্বলন্ত লাল লোহা দিয়ে তার চোখ পুড়িয়ে দিতে। এই ঘৃণ্য কাজ করা হল। অন্ধ পৃথ্বীরাজকে প্রতিদিনই এই বর্বর ঘোরীর কাছে রাজসভায় আনা হত এবং ঘোরী এবং তার সভাপতি তাঁর সঙ্গে বিদ্রুপ করত।
পৃথ্বীরাজের দুর্দিনে চাঁদ বরদাই ঘোরীর কাছাকাছি এলেন। চাঁদ বরদাই ছদ্মবেশে এবং নিজে সুরক্ষিত স্থানে মাহমুদের রাজসভায় দক্ষ কবিতা রচয়িতা হিসাবে হাজির হলেন। ঘোরী যখন তিরন্দাজী প্রতিযোগিতার কথা ঘোষণা করলেন দুজনেই প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ গ্রহণ করলেন। চাঁদ বরদাই মাহমুদকে বললেন যে পৃথ্বীরাজ তিরন্দাজীতে এত নিপূণ যে সে ব্যক্তি বা বস্তু না দেখে কেবলমাত্র শব্দ শুনে লক্ষ্যবস্তুর ওপর সঠিক তির চালিত করেন। হতভাগ্য অন্ধ পৃথ্বীরাজকে তিরন্দাজী প্রতিযোগিতা স্থলে আনা হল এবং তিরধনুক দেওয়া হল। কানে কানে বরদাই ঘোরী কোথায় বসে আছে সেইদিকের কথা পৃথ্বীরাজকে বলে দিলেন। তিনি পৃথ্বীরাজকে শোনানোর জন্য ছোটো কবিতা রচনা ও আবৃত্তি করে ঘোরী কোথায় আছেন তার সংকেত দিলেন।
এমন এক ভাষায় কবিতাটি রচনা করলেন যেটি একমাত্র পৃথ্বীরাজ বুঝতে পারবেন। কবিতাটি বলতে লাগলেন-
চার বান্স, চব্বিশ গজ, আঙুল অষ্টপ্রমাণ, এতে পায় হ্যায় সুলতান, তো উপর হ্যায় মুলতান আব সাত চুকো হে চৌহান।
তোমার দশ পরিমাণ সামনে, চব্বিশ ফুট দূরে, সুলতান বসে আছেন, চৌহান তুমি এখন হাতে পেয়ে ছেড়ে দিওনা।
ঘোরী পৃথ্বীরাজকে তীর ছুড়তে আদেশ দিলেন। পৃথ্বীরাজ তখন ঘোরী যেদিকে বসেছিলেন সেদিকে ঘুরে বরদাই-এর কবিতার স্বর মনে রেখে লক্ষ্য স্থির করলেন এবং তিরটি ঘোড়ীর গলা বিদ্ধ করল। তিরের আঘাতে ঘোরী মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু পৃথ্বীরাজের বিশ্বাসঘাতকেরা পৃথ্বীরাজের প্রতিশোধ নিল এবং তার দর্পচূর্ণ করল।