অলিম্পিক গেমস্
অলিম্পিক গেম্স্ বিবেচিত হয় পৃথিবীর সর্বোত্তম খেলাধুলার প্রতিযোগিতা যেখানে দুশোর বেশি দেশ অংশগ্রহণ করে। বর্তমানে এই গেমস্ দ্বিবৎসর অন্তর গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন অলিম্পিক গেমস্ হিসাবে পালানুযায়ী অনুষ্ঠিত হয় অর্থাৎ প্রতিটি গেম্স্ প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়।
এই প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার প্রেরণা ছিল গ্রিসের অলিম্পিয়ায় জিউস্-এর পবিত্র স্থানে অনুষ্ঠিত ব্যায়াম সংক্রান্ত উৎসব যেটা চলেছিল খ্রিঃ পূঃ অষ্টম শতক থেকে চতুর্থ শতক এ.ডি. পর্যন্ত।
১৮৯৪ সালে ব্যারন পিয়েরে ডে কৌবার্টিন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আই ও সি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সেই থেকে অলিম্পিক সনন্দ অনুযায়ী গঠন ও প্রাধিকার সহ আই. ও. সি পরিচালকবর্গ হিসাবে অলিম্পিক যাত্রায় সামিল হয়েছে।
বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে অলিম্পিক যাত্রার ক্রম বিকাশের ফলস্বরূপ অলিম্পিক গেম্স্-এ অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বরফে ও শীতে খেলাধুলার জন্য শীতকালীন অলিম্পিক গেম্স্, অসমর্থ খেলোয়াড়দের জন্য প্যারিলিম্পিক গেম্স্ এবং নাবালক খেলোয়াড়দের জন্য ইউথ অলিম্পিক গেম্স্-এর অন্তর্ভুক্তিকরণ ঘটেছে।
দুটো বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯১৬, ১৯৪০ এবং ১৯৪৪ এই তিন বছর অলিম্পিক গেম্স্ বাতিল হয়েছিল। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সময় অলিম্পিক বর্জন করায় ১৯৮০ এবং ১৯৮৪ সালে সীমিত সংখ্যক দেশ অলিম্পিকে অংশ গ্রহণ করেছিল।
অলিম্পিকের অনেক রীতি ও প্রতীক আছে যেমন, অলিম্পিক পতাকা, মশাল। তেমনই উদ্বোধনী ও সমাপ্তি অনুষ্ঠান। গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন অলিম্পিকে তেত্রিশ রকমের বিভিন্ন খেলাধুলায় প্রায় ৪০০ ইভেন্টে ১৩০০০-এর বেশি অ্যাথলিট প্রতিযোগিতা করে। প্রত্যেক ইভেন্তে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থমানাধিকারীকে যথাক্রমে সোনার, রূপার এবং ব্রোঞ্জের অলিম্পিক পদক দেওয়া হয়।
১৯১৪ সালে পিয়েরে ডে কৌবার্টিন সৃষ্ট অলিম্পিক পতাকায় সাদা পটভূমিকায় পাঁচটি অন্তসংযুক্ত গোলাকার বলয় থাকে। পাঁচটি বলয় পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ মহাদেশের প্রতীক এবং অন্তসংযুক্তি করণের দ্বারা এই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার প্রতীক চিহ্নিত করে। বাঁদিক থেকে বলয়গুলি যথাক্রমে নীল, হলুদ, কালো, সবুজ এবং লাল রঙের। এই রংগুলি বাছার কারন এর অন্তত একটি রং বিশ্বের যে-কোনো দেশের পতাকায় দেখা যায়। অলিম্পিক পতাকা প্রথম উত্তোলিত হয়েছিল ১৯২০ সালের অলিম্পিক গেম্স্-এ।
আধুনিক অলিম্পিকের প্রতিষ্ঠাতা, পিয়েরে ডে কৌবার্টিন ১৯২১ সালে তার বন্ধু ফাদার হেনরি ডিভন-এর কাছ থেকে ল্যাটিন ভাষায় কিছু শব্দগুচ্ছ নিয়েছিলেন অলিম্পিকের ‘মোটো’ প্রকাশের জন্য; “সিটিয়াস, অলটিয়াস, ফরটিয়াস” (বেগবান, উচ্চবান, বলবান)।
পিয়েরে ডে কৌবার্টিন অ্যাথলিটদের জন্য একটি শপথ নিয়েছিলেন যা প্রতিটি অলিম্পিক গেম্স্-এ পাঠ করা হয়। উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে একজন অ্যাথলিট সমস্ত অ্যাথলিটদের হয়ে এই শপথ বাক্য পাঠ করেন। ১৯২০ সালের অলিম্পিক গেম্স্-এ বেলজিয়ান ফেন্সার ভিক্টর বয়েন প্রথম অলিম্পিক শপথ নিয়েছিলেন। এই অলিম্পিকে শপথে বলা হয়, “আমি শপথ করি যে খেলার উৎকর্ষতা এবং আমাদের দলের সম্মানের জন্য যথাযথ খেলোয়াড়চিত মানসিকতায় আরোপিত নিয়মাবলির প্রতি সম্মানপূর্বক মেনে চলার অঙ্গীকার নিয়ে আমরা এই অলিম্পিক গেম্স্-এ অংশ গ্রহণ করছি”।
অলিম্পিক অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত রাখার রীতি প্রাচীন অলিম্পিক গেম্স্ থেকেই চলে আসছে। গ্রিসের অলিম্পিয়ায় সূর্যের রশ্মি থেকে আগুন জ্বালানো হত। আধুনিক অলিম্পিকে ১৯২৮ সালে আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেম্স্-এ এই আগুন প্রথম প্রজ্জ্বলিত হয়। এই অগ্নিশিখা অনেক কিছুর সঙ্গে শুদ্ধতা এবং পূর্ণতা প্রাপ্তির চেষ্টাও প্রকাশ করে। এখনকার অলিম্পিক মশাল পরিক্রমা শুরু হয়েছিল ১৯৩৬ সালের অলিম্পিক গেমস অর্গানাইজেশন কমিটির চেয়ারম্যান কার্ল ভিয়েন-এর পরামর্শে। অলিম্পিয়ার সেই প্রাচীন জায়গায়, প্রাচীন আকৃতির পোশাক পরিহিত মহিলাদের দ্বারা বাঁকানো আয়না ও সূর্যের রশ্মি ব্যবহার করে অলিম্পিকে অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করা হয়। তারপর সেই অলিম্পিক মশাল অলিম্পিয়ায় প্রাচীন ক্ষেত্র থেকে দূত বা রানার মারফত রিলে সিস্টেমে অলিম্পিক আয়োজক দেশে নিয়ে আসা হয়। এই অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত রাখা হয় অলিম্পিক গেম্স্ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। এই অলিম্পিক মশাল প্রাচীন অলিম্পিক গেমস থেকে আধুনিক অলিম্পিকের ধারাবাহিকতার প্রতীক স্বরূপ।
অলিম্পিক পতাকা উত্তোলনের সময় স্পাইরস সামারাস দ্বারা সুর সংযোজিত ও কস্টিস্ পালামাস কথিত অলিম্পিক স্তোত্র বাজানো হয়। ১৮৯৬ সালে এথেন্সে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমস-এ এই গাথা প্রথম বাজানো হয়েছিল কিন্তু ১৯৫৭ সালের আগে পর্যন্ত আই ও সি স্বীকৃত-গাথা বা স্তোত্র প্রকাশ করে নি।
পুরো সোনার তৈরি সোনার পদক প্রদান করা হয়েছিল ১৯১২ সালে।
প্রত্যেক অলিম্পিক গেমস-এর জন্য তৈরি অলিম্পিক পদকের আকৃতি আয়োজক শহরের অর্গানাইজিং কমিটির দ্বারা বিশেষভাবে নির্ধারিত হয়। প্রতিটি পদক হবে তিন মিলিমিটার মোটা এবং ৬০ মলিমিটার ব্যাসযুক্ত। স্বর্ণ এবং রৌপ্য পদকে শতকরা ৯২.৫ ভাগ রূপো থাকবে আর স্বর্ণপদক ছয় গ্রাম সোনা দিয়ে ঢাকা থাকবে।
১৯০৮ সালে লণ্ডনে অলিম্পিক গেম্স্-এ প্রথম উদ্বোধনি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল।
অলিম্পিক গেম্স্-এর উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে অ্যাথলিটদের মিছিলে গ্রিক দল সবসময় আগে থাকে এবং অন্যান্য দল আয়োজক দেশ ছাড়া বর্ণানুক্রমিক (আয়োজক দেশের ভাষা অনুযায়ী) পরপর থাকে। শেষ দল সবসময় আয়োজক দেশ হয়ে থাকে।
অলিম্পিক গেম্স্-এর স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে আই ও সি সবসময় দেশের থেকে শহরকে গুরুত্ব বেশি দেয়।
আধুনিক অলিম্পিক গেম্স্-এ প্রথম অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন ছিলেন হপ, স্টেপ এবং জাম্প (১৮৯৬ অলিম্পিকের প্রথম চুড়ান্ত খেলায়) বিজয়ী জেমস বি. কনোলি (ইউনাইটেড স্টেটস)।
৪৯০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে আক্রমণে উদ্যত পারসিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধের ফলাফল এথেলিয়ানদের জানাতে একজন গ্রিক যোদ্ধা ফিদিপাইদেস্ ম্যারাথন থেকে এথেন্স (প্রায় ২৫ কি মি) ছুটে গেছিল পাহাড় ও অন্যান্য বাধা অতিক্রম করে এবং এথেন্সে পৌছেছিল খুবই খারাপ অবস্থায় রক্তাক্ত পায়ে। শহরবাসীদের গ্রিকদের জয়লাভের কথা বলে ফিদিপাইদেস মাটিতে পড়ে যায় ও মারা যায়। ১৮৯৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম আধুনিক অলিম্পিক গেম্স্-এ ফিদিপাইদেসের স্মরণার্থে প্রায় একই দূরত্বের একটি দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজিত হয়েছিল।
প্রথম কয়েকটি আধুনিক অলিম্পিকে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা প্রায় একই দূরত্বের ছিল। ১৯০৮ সালে ব্রিটিশ রাজপরিবার অনুরোধ করে উইন্ডসোর ক্যাসল থেকে ম্যারাথন শুরু করার জন্য যাতে রাজপরিবারের ছেলেমেয়েরা শুরুটা দেখতে পায়। উইন্ডসোর ক্যাস্ল্ থেকে অলিম্পিক স্টেডিয়ামের দূরত্ব ছিল ৪২১৯৫ মিটার (অথবা ২৬ মাইল ও ৩৮৫ গজ)। ১৯২৪ সালে এই দূরত্ব একটি নির্ধারিত মানে স্থির করা হয়।
১৯০০ সালের দ্বিতীয় আধুনিক অলিম্পিক গেম্স্-এ মেয়েদের প্রথম অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়।
সামার অলিম্পিক যে শহরে হবে তার কয়েক মাস আগে অন্য শহরে করার প্রথা নিয়ে প্রথম শীতকালীন অলিম্পিক গেম্স্ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৪ সালে ফ্রান্সের চ্যামোনিক্স শহরে। ১৯৯৪ সালের শুরুতে শীতকালীন অলিম্পিক গেম্স্ অনুষ্ঠিত হয়েছিল একেবারে অন্য বছর (অর্থাৎ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেম্স্ এর ২ বছর পর)।
১৯২৪ সাল পর্যন্ত অলিম্পিকে টেনিস খেলার প্রচলন ছিল। পরে আবার ১৯৮৮ সালে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মোটর বোটিং ১৯০৮ সালে অলিম্পিকে স্বীকৃত খেলা হিসাবে গৃহীত হয়। অলিম্পিকে পোলো খেলা চলেছিল ১৯০০, ১৯০৮, ১৯২০, ১৯৩৬ সালে।
যদিও রাশিয়া ১৯০৮ এবং ১৯১২ সালের অলিম্পিকে কিছু সংখ্যক অ্যাথলিটদের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পাঠিয়েছিল, কিন্তু ১৯৫২ সালের আগে তারা কখনও অংশ নেয় নি।
সবচেয়ে বয়স্ক অলিম্পিক পদকজয়ী হলেন সুইডেনের অস্কার স্বান। তিনি শেষ পদক জিতেছিলেন ৯২ বছর বয়সে।
গ্রিক শব্দ ‘জিম্নোজ’ অর্থাৎ ‘উলঙ্গ’ থেকে ‘জিমন্যাসিয়াম’ কথাটির উৎপত্তি। ‘জিমন্যাসিয়াম’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘উলঙ্গ ব্যায়াম শিক্ষার বিদ্যালয়’। প্রাচীন অলিম্পিক গেম্স্-এ অ্যাথলিটরা উলঙ্গ অবস্থায় অংশগ্রহণ করত।
দুটি অলিম্পিক গেম্স্-এর মধ্যবর্তী চার বছর হল ‘অলিম্পিয়াড’, অলিম্পিক গেম্স্ প্রত্যেক অলিম্পিয়াড্কে স্মরণ করে। আধুনিক অলিম্পিক গেম্স্-এর জন্য প্রথম অলিম্পিয়াড্ সেলিব্রেশন হয়েছিল ১৮৯৬ সালে। প্রতি চার বছর আলাদা অলিম্পিয়াড পালন করা হয়। এইভাবে গেম্স্ বাতিল (১৯১৬, ১৯৪০ এবং ১৯৪৪) হলেও অলিম্পিয়াডও গণ্য করা হয়। ২০০৪ সালের এথেন্সে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেম্স্ ২৮তম অলিম্পিয়াড-এর গেমস্ হিসাবে পরিচিত।
আধুনিক অলিম্পিক গেমস্ ২৯ বার অনুষ্ঠিত হয়েছে (২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিক পর্যন্ত) এর মধ্যে ইউরোপে আয়োজিত হয়েছিল ১৫ বার, নর্থ আমেরিকায় ৫ বার, এশিয়ায় ৩ বার এবং অস্ট্রেলিয়ায় ২ বার। আফ্রিকা এবং আন্টার্কটিকা এই তিনটি মহাদেশে কখনও অলিম্পিক গেমস্ আয়োজিত হয়নি।