ভারতে প্রতিরক্ষা গবেষণা (Defence Research in India)
ডিফেন্স রিসার্চ এবং ডেভেলপ্মেন্ট অর্গানাইজেশন্ (DRDO)
১৯৫৮ সালে স্থাপিত হয়েছিল। জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় একটি শক্ত ভিত্তি প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে।
ডি আর ডি ও সূত্র নির্ধারণ করে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও নকশা তৈরির আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর প্রয়োজনীয় নতুন অস্ত্রের উন্নয়ন ঘটায়।
ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিশাইল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (IGMDP) কাজ শুরু করেছিল ১৯৮৩ সালে যার ফলে নিম্নলিখিত ক্ষেপণাস্ত্রের বিকাশ ঘটেছিল।
অগ্নি (Agni)
আই জি এম ডি পি-র তত্ত্বাবধানে ভারতে তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র হচ্ছে একটি মাঝারি দূরত্বের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আই আর বি এম)। এটা প্রথম পরীক্ষিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে চাঁদিপুর অস্থায়ী পরীক্ষাকেন্দ্র এবং ১০০০ কেজি ওজনের প্রচলিত ভার বা আণবিক বোমা বহনে সক্ষম। এটা একটি পর্যায় (স্বল্প দূরত্ব) বা দুটি পর্যায় (মাঝারি দূরত্ব) নিয়ে গঠিত। এটি ট্রেনে বা রাস্তায় বহনযোগ্য। এটি শক্তি সঞ্চারিত হয় কঠিন এবং অথবা তরল জ্বালানির সাহায্যে।
অগ্নির বিভিন্নতা(Variants of Agni)
অগ্নি-I: স্বদেশে বিকশিত আণবিক বোমা বহনে সক্ষম অগ্নি-১ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ৭০৯ কিমি দূরত্বে আঘাত করতে পারে। এটি একটি একক পর্যায় ক্ষেপণাস্ত্র যা শক্তি লাভ করে কঠিন জ্বালানির মাধ্যমে এবং এর বিশেষ গমন পদ্ধতি লক্ষ্যবস্তুকে নির্ভুলভাবে আঘাত করা নিশ্চিত করে। এর ওজন ১২-টন ওজনের আণবিক বোমা বহনে সক্ষম।
অগ্নি-II: এই আণবিক বোমা বহনে সক্ষম স্বদেশে প্রস্তুত ভূমি থেকে ভূমি দুটি পর্যায় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ২০০০ কিমি দূরত্বে আঘাত করতে পারে। এটি ২০মিটার লম্বা এবং ১টন ওজনের আণবিক বোমা বহনে সক্ষম।
অগ্নি-III: এই আণবিক বোমা বহনে সক্ষম ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ৩০০০ কি.মি. দূরত্বে আঘাত করতে পারে। স্বদেশে প্রস্তুত এই ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র ১.৫ টন ওজন বহনে সক্ষম এবং দুটি পর্যায় কঠিন জ্বালানির মাধ্যমে শক্তি সঞ্চার করে।
অগ্নি-IV: এই আণবিক বোমা বহনে সক্ষম কৌশলী ক্ষেপণাস্ত্র ৩০০০ কি.মি. দূরত্বে আঘাত করতে পারে। এই সুচারুভাবে নির্মিত ক্ষেপণাস্ত্রটির ওজন হালকা এবং দুটি পর্যায় কঠিন জ্বালানি বিশিষ্ট। চাপানো ভার (পেলোড) তাপমাত্রার পুনঃপ্রবেশ রোধক বর্মের দ্বারা তাপমাত্রা ৩০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস-এর বেশি বাড়তে দেয় না।
অগ্নি-V: অগ্নি ৫ হল ভারতের অভিনব আণবিক অগ্রভাগ যুক্ত আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আই.সি.বি.এম), ৫০০০ কিমি দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুকে এই ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করতে পারে এবং চলনশীল উৎক্ষেপক থেকেই উৎক্ষেপিত হতে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ৬০০কি. উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে এবং ৭০০০ মি/সেকেন্ড গতিতে যেতে পারে। স্বদেশে প্রস্তুত অগ্নি-৫ ১৭.৫ মি। লম্বা, কঠিন জ্বালানি সমৃদ্ধ, ভূমি থেকে ভূমি, তিনটি পর্যায়ভুক্ত ৫০টন ওজনের ক্ষেপণাস্ত্র যাতে ১.৫ টন ওজনের বিস্ফোরক রাখা যেতে পারে। অগ্নি-৫ এর সফল উৎক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে ভারত যোগদান করেছে সম্ভ্রান্ত দেশ গোষ্ঠিতে (ইউ.এস.এ, রাশিয়া, চিন, ইউ কে এবং ফ্রান্স), যাদের এই প্রযুক্তি আছে।
পৃথ্বী
পৃথ্বী ক্ষেপণাস্ত্র হচ্ছে একটি কৌশলী ভূমি থেকে ভূমি সম দূরত্বের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (এস আর বি এম)। এটা ছিল ভারতের প্রথম স্বদেশে প্রস্তুত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। পৃথ্বীর উন্নয়ন শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালে এবং প্রথম পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয়েছিল ১৯৮৮ সালে ২৫শে ফেব্রুয়ারি অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটা থেকে।
পৃথ্বীর রকমভেদ
আই জি এম ডি পি-র প্রারম্ভিক পরিকাঠামোর রূপরেখার মাধ্যমে পৃথ্বী ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের উন্নয়ন ভারতের স্থলবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীর জন্য তিন ভাবে হয়েছিল।
পৃথ্বী-I: স্থলবাহিনীর জন্য (১৫০ কিমি দূরত্ব সঙ্গে ১০০০ কেজি ভার)
পৃথ্বী-II: বিমানবাহিনীর জন্য (২০০ কিমি দূরত্ব সঙ্গে ৫০০ কেজি ভার)
পৃথ্বী-III: নৌবাহিনীর জন্য (৩৫০ কিমি দূরত্ব সঙ্গে ৫০০ কেজি ভার)
ধনুশ
ধনুশ হচ্ছে নৌবাহিনীর জন্য তৈরি পৃথ্বীর কম দূরত্বের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র যা জাহাজের উপরিভাগ থেকে উৎক্ষেপিত হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কথা অনুযায়ী ৮.৫৩ মিটার লম্বা এবং ০.৯ মিটার চওড়া ধনুশ ৫০০ কেজি ভার নিয়ে ৩৫০ কিমি দূরত্বে আঘাত করার ক্ষমতা সহ শীঘ্রই নৌবাহিনীতে কাজ শুরু করবে।
আকাশ
আকাশ একটি মাঝারি পাল্লার ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র যা ৩০ কিমি পাল্লাতেও ব্যবহৃত হতে পারে। উৎক্ষেপণের সময় এর ওজন ৭২০কেজি, ৩৫ সেমি ব্যাস এবং ৫.৮ মিটার লম্বা। আকাশ শব্দের চেয়েও দ্রুতগামী, ম্যাক ২.৫ এর মধ্যেই পৌঁছে যায়। এটা ১৮ কিমি উচ্চতায় উঠতে পারে। এটা কঠিন জ্বালানির মাধ্যমে চালিত হয়।
ত্রিশূল
ত্রিশূল হচ্ছে কম পাল্লার ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র। এর পাল্লা ৯ কিমি এবং ৫.৫ কেজি ওজনের ওয়ারহেড যুক্ত। কম দূরত্বের এবং কম উচ্চতার (সমুদ্র জলস্তর) লক্ষ্যে আঘাত করার জন্য পরিকল্পিত। এই পদ্ধতি কার্যকর করা হয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র থেকে নৌবাহিনীর জলযান রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এবং স্থলে কম দূরত্বের ‘ভূমি থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে।
নাগ
নাগ হচ্ছে ভারতের তৃতীয় প্রজন্মের ‘ফায়ার অ্যান্ড ফরগেট’ ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। এটা হচ্ছে সবরকম আবহাওয়া উপযুক্ত ৩ থেকে ৭ কিমি দূরত্বের মধ্যে অতি আক্রমণাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র। স্থলবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর জন্য আলাদা আলাদা সংস্করণ তৈরি করা হচ্ছে।
শৌর্য্য
শৌর্য্য ক্ষেপণাস্ত্র হচ্ছে ভারতীয় স্থলবাহিনীর জন্য কম পাল্লার ভূমি থেকে ভূমি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৬০০ কিমি এবং এটি ১ টন ওজনের প্রচলিত বা আণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম। ভারত তার শৌর্য্য ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণভাবে দ্বিতীয় আঘাত করার সক্ষমতা লাভ করেছে। শৌর্য্য হল জলের নীচে উৎক্ষেপিত কে-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র ‘সাগরিকার’ স্থল সংস্করণ।
ব্রহ্মস্
ব্রহ্মস্ হচ্ছে শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী ক্রুইজ্ ক্ষেপণাস্ত্র যা ডুবোজাহাজ, জাহাজ, বিমান এবং ভূমি থেকে উৎক্ষেপিত হতে পারে। এটা হচ্ছে ভারতের ‘ডি আর ডিও’ এবং রাশিয়ার এন পি ও ম্যাশিনোস্ট্রোইয়েনিয়া-র যৌথ উদ্যোগ যার নাম ব্রহ্মস্ এয়ারোস্পেস প্রাইভেট লিমিটেড। এর কার্যকরী পাল্লা ২৯০ কিমি।
ব্রহ্মস্ শব্দটি নেওয়া হয়েছিল দুটি দেশের একসাথে চলা বোঝাতে দুটি নদীর নামে-ভারতের ব্রহ্মপুত্র এবং রাশিয়ার মস্কোভা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী ক্রুইজ ক্ষেপণাস্ত্র যার গতি ম্যাক ২.৫ থেকে ২.৮। এই ক্ষেপণাস্ত্রের আরও দ্রুতগামী (হাইপারসনিক) সংস্করণ তৈরির পথে।
অন্যান্য উন্নয়ন (Other Developments)
আই জি এম ডি পি দ্বারা উদ্ভাবিত দক্ষতা ও প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে নতুন ব্যালিস্টিক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র তথা এক্সোঅ্যাটমোস্ফেরিক ইন্টারসেপটার সিস্টেম তৈরির ক্ষেত্রে যা সফলতার সঙ্গে ধ্বংস করেছিল পৃথ্বী-II ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।
বিশ্বে ভারত হল চতুর্থ দেশ যারা এই সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং তৃতীয় দেশ যারা এর উদ্ভাবন ঘটিয়েছে স্বদেশি প্রক্রিয়ায়। ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারত সফলতার সঙ্গে পরীক্ষা করেছিল এক্সোঅ্যাটমোস্ফেরিক সংস্করণের যা রূপান্তরিত পৃথ্বী-II ক্ষেপণাস্ত্র নিখুঁতভাবে ধ্বংস করেছিল ১৫ কিমি উচ্চতায়। এর মাধ্যমে ভারতে সম্পূর্ণ করেছিল এমন এক পদ্ধতির যাকে বলা হয় মাল্টি লেয়ার্ড থিয়েট্রিক্যাল ওয়াইড-এরিয়া এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম যা সফলতার সঙ্গে ১৫ থেকে ৫০কিমি উপরে যে কোনো কোণ থেকে এবং দিগংশ বরাবর লক্ষ করে এবং ধ্বংস করে সমস্ত রকম বায়বীয় ভয় অর্থাৎ নীচুতে ওড়া ক্রুইজ ক্ষেপণাস্ত্র, শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী কম পাল্লার, মাঝারি পাল্লার এবং আন্তর্মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র।